রামপুর সহসওয়ান ঘরানার প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী প্রথমে পুরিয়া রাগে গাইলেন- প্রীত লগন প্রিয়া।
শহর ঢাকা ডুবে আছে সুরে। আগের তিন দিনের চেয়েও আজ আরও বেশি মানুষের ভিড় ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে। প্যান্ডেল ছাপিয়ে দর্শক পুরো মাঠ জুড়েই। সবার মাথার ওপরে ত্রিপল নাই। তাতে কী! সামনে আছেন রশীদ খান, পণ্ডিত যশরাজ। হ্যাঁ। এমনই আজ বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের চতুর্থ দিনের চেহারা। আয়োজনের শুরু সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায়।
শুরুতেই বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের দলগত নৃত্য- নৃত্য চিরন্তন: মনিপুরি, ভারতনাট্যম, কত্থক নৃত্যার্ঘ। পরিচালনায় ছিলেন গুরু বিপিন সিংহ, পণ্ডিত বিরজু মহারাজ, শিবলী মোহাম্মদ। সমন্বয়কারী ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরে সরোদে রাগ ভূপালি দলবদ্ধ ভাবে পরিবেশন করেন বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীরা।
রাত ৯ টা ৩১ মিনিটে মঞ্চে এলেন উস্তাদ রশিদ খান। রামপুর সহসওয়ান ঘরানার প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী প্রথমে পুরিয়া রাগে গাইলেন- প্রীত লগন প্রিয়া। তিনি তাঁর নিজের সৃষ্টি- প্রিয়ারঞ্জনী রাগে আরেকটি খেয়াল শোনালেন। মাঠজুড়ে তখন অদ্ভুত এক মুগ্ধতা, পিতা রশিদ খানের সঙ্গে পরিবেশনায় তাঁর সন্তানও ছিলেন। কণ্ঠ সহযোগিতায় ছিলেন নাগনাথ আদগাঁওকার, তবলায় ছিলেন পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হারমোনিয়ামে অজয় যোগলেকর ও সারেঙ্গিতে ছিলেন উস্তাদ সাবির খান।
আরও পড়ুন:
সুরে ডুবে ঢাকা, তৃতীয় রাত শেষ হল অজয় চক্রবর্তীর ভৈরবীতে
উদ্বোধন হল বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের
খেয়ালের শেষেই আরেক জাদু- সরোদ ও বেহালার যুগলবন্দী। পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং মাইশুর মঞ্জুনাথ এক সঙ্গে রাগ সিমেন্দ্রমধ্যম নিয়ে মঞ্চে। তাঁদের সঙ্গে তবলায় পণ্ডিত যোগেশ শামসি এবং মৃদঙ্গমে ছিলেন অর্জুন কুমার।
খেয়ালের সুর থামিয়ে দিয়েছে ঘড়ি। মাঠ জুড়ে তখন এক অপার্থিব পরিবেশ।
রাত ১১ টা ২৫ মিনিটে এলেন পণ্ডিত যশরাজ।
যোগিয়ার জাদুতে মুগ্ধ প্রায় ১০ হাজার দর্শক শ্রোতা। খেয়ালের সুর থামিয়ে দিয়েছে ঘড়ি। মাঠ জুড়ে এক অপার্থিব পরিবেশ। বয়োজেষ্ঠ পণ্ডিত গাইছেন- ১৫ থেকে ৮৫ সবাই নির্বাক। এই তো সংগীতের ক্ষমতা- শুধু সুর আর স্বরে স্তব্ধতা ভাঙে- মাঠে বসা হাজারো দর্শক তখন ভুলে গিয়েছেন কথা বলতে।
রাত ২ টে ৫ মিনিটে এলেন- সাসকিয়া রাও দ্য-হাস। পাশ্চাত্য ঘরানার হলেও ৯৩ সালে একটি কনসার্টে যোগ দিতে ভারতে এসে সঙ্গীতের নতুন পথে চলতে শুরু করেন তিনি। তাঁর বানে চেলো পেয়েছে নতুন মাত্রা। তাঁর হাতে শব্দযন্ত্রটির আকারেও অনেকটা বদল ঘটেছে। নেদারল্যান্ডসের এই কৃতি শিল্পী সবুজ শাড়ী লাল পাড়ে যেন নিতান্তই বাঙালী। তিনি শেষে বাজালেন রবীন্দ্রনাথের- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। তখন মাঠের অধিকাংশ দর্শক উঠে দাড়িয়ে তালে তালে তালি দিয়ে চলেছে।
রাত ৩ টে ৫০ মিনিটে এলেন পণ্ডিত বুদ্ধ্যাদিত্য মুখোপাধ্যায়। পিতা এক সময়ে বাংলাদেশে ছিলেন, একথা জানাতেই দর্শকের করতালি ছিল আপনজনকে বরণ করে নেওয়ার মতো। সেতারের যাদুতে শুরু হলো আরেক মুগ্ধতা- সৌমেন নন্দীর তবলায় ললিত তখন ডেকে আনছে দিনের প্রথম প্রহর। তিনি শেষ করলেন প্রভাতের রাগ ভৈরবীতে, চেনা সুর- বাবুল মেরা- নৈহর ছুটওহি যায়.....। বাহাদুর শাহ জাফরের পদ্য তখন মাঠজুড়ে স্পর্শ করছে সবাইকে।
উৎসবের চতুর্থ দিনের শেষ রাতে ঢাকার আকাশে কুয়াশা তেমন ছিল না, তবে শীত আগের দিনের চেয়ে বেশি। তবু ভোর ৫ টে ১০ পর্যন্ত সেতারের সঙ্গে ঢুবে থাকা মানুষদের স্পর্শ করেনি শীতের তীব্রতা, কারণ শীতকে জয় করেছে সুরের উষ্ণতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy