আবৃত্তির ক্লাসরুমে আমরা এসেছিলাম ছ’মাস আগে। আপনাদের সঙ্গে মাস ছয়েক কাটানোর পর এ বার আমার ঘরে ফেরার পালা। আমার কিছু অনুসন্ধান এবং অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব— এ কথা বলেছিলাম একেবারে প্রথম ক্লাসে।
নিজের কথা বলতে বলতে শুনতে পেয়েছি আপনাদের কথাও। অনেক চিঠি পেয়েছি ই-মেলে। বেশ কিছু চিঠির উত্তর দিয়েছি ইতিমধ্যে। আরও কিছু চিঠি এসেছে। তার মধ্যে কয়েকটার কথা বলি। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের অধ্যাপক বিকাশ পাল ছন্দ এবং যতি বিষয়ক লেখা দুটি নিয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে সঠিক স্থানে Pause-এর ব্যবহার নিয়ে তিনি একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁর মতে, মান্না দে’র গানে Pause-এর চমৎকার ব্যবহার দেখা যায়। ঠিক জায়গায় একেবারে ঠিক সময় ধরে থেমে থাকা, আর তার পরেই সঠিক অনুভূতিতে পরের শব্দটা গেয়ে ওঠা— তাঁর গানকে নতুন জীবন দিয়েছে। তিনি ঠিকই বলেছেন। সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ের Pause-এর ব্যবহার এক অনন্ত সম্ভাবনা তৈরি করে। আর সম্ভাবনার শেষে এক নতুন সৃষ্টিতে উপনীত হয়। চিঠির শেষে পত্রলেখক অবশ্য প্রশ্ন করেছেন উচ্চারণ নিয়ে। জানতে চেয়েছেন শ, ষ, আর স-এর উচ্চারণ কী ভাবে আলাদা করা যাবে! প্রথমেই বলি, বাংলায় ষ-র আলাদা উচ্চারণ নেই। শ আর ষ-এর উচ্চারণ ইংরেজি sh-এর মতো, আর স-এর উচ্চারণ ইংরেজি s-এর মতো। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে উচ্চারণ সংক্রান্ত লেখাটিতে। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলা লাভ আর ইংরেজি love এক নয়’।
কলকাতা থেকে লিখেছে ঊর্মিমালা। কোনও কবিতা যদি সংলাপধর্মী হয় তাহলে গলাটা কি পুরোপুরি বদলাব? নাকি নিজের গলাতেই সুর পরিবর্তন করে বলব? অন্য কোনও চরিত্র, যেমন পুরুষের বা বৃদ্ধের গলা কী ভাবে প্রকাশ করব? উত্তরে বলি, আবৃত্তিতে সংলাপধর্মী কবিতায় নিজের গলা পালটানোর দরকার নেই। কথা বলার ধরনটা, স্বরক্ষেপণটা পালটানো যেতে পারে। একটা উদাহরণ দিই। রবীন্দ্রনাথের ব্রাক্ষ্মণ কবিতার তিনটি চরিত্র—গৌতম, জবালা, সত্যকাম। গৌতম—স্থিতধী ঋষি, প্রজ্ঞাবান। জবালা— প্রান্তিক নারী, কুণ্ঠিত, যৌবনে বহু পুরুষের পরিচর্যায় তার দিন গিয়েছে। সত্যকামের পিতৃপরিচয় জানা নেই বলে তার কুণ্ঠা আছে। আর সত্যকাম এক জ্ঞানপিপাসু বালক, নিষ্পাপ, সরল। নিজের পিতৃপরিচয় জানা নেই—এ কথায় কুণ্ঠিত নয় সে। কণ্ঠস্বরে এই চরিত্রগুলোকে তুলে ধরতে হবে। চরিত্রগুলো আসবে স্বরক্ষেপণে, বাচনভঙ্গিতে। ঋষি গৌতমের প্রজ্ঞা, জবালার কুণ্ঠা আর সত্যকামের ঋজুতা, সরলতা— বাচনভঙ্গিতেই ফোটাতে হবে। ঋষি গৌতমের উক্তিগুলি বলার সময় পুরুষের গলায় কথা বলার চেষ্টা করলে শুধু কৃত্রিমই শোনাবে না, হাস্যকরও মনে হবে। শ্রুতিনাটকে কিন্তু চরিত্রটা হয়ে উঠতে হয়। কোনও বৃদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে বৃদ্ধার গলাতেই বলতে হবে। আর স্বাভাবিক ভাবে, শ্রুতিনাটকে পুরুষের চরিত্রে অভিনয় করতে হয় না। তবে যদি কখনও পুরুষের উক্তি বলতে হয়, একক অভিনয়ের ক্ষেত্রে বা সংলাপের মধ্যে সংলাপ থাকলে, তাহলে নিজের গলাতেই বলতে হয়। তৃপ্তি মিত্রের অপরাজিতা, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানা রঙের দিন, শাঁওলি মিত্রের নাথবতী অনাথবৎ কিংবা স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর শানু রায়চৌধুরী—এগুলো শুনলে বোঝা যায় শুধুমাত্র নিজের গলাতেই কত চরিত্র নির্মাণ করা যায়। এ রকম উদাহরণ আরও আছে।
একেবারে অন্য রকম একটা চিঠি দিয়েছেন অনুপ মুখার্জি। জানিয়েছেন, তিনি প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়ের একজন অনুরাগী পাঠক। লেখকের যমুনোত্রী হতে গঙ্গোত্রী ও গোমুখ বইটি প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছেন, বইটির পুরোটাই কি নন-ফিকশন, নাকি তার সঙ্গে মিথও মিশে আছে? উদাহরণ হিসেবে বলেছেন গোমুখের কাছে গন্ধর্বলোকের কথা। বইটি আমি পড়িনি। তবে সাধারণ ভাবে যা বুঝি, নন-ফিকশনে মূল ঘটনাটি বাস্তব। কিন্তু লেখকের তো কোনও মিথ, কোনও গল্প মনে পড়তেই পারে। সেটা তিনি লিখতেই পারেন। তবে যেহেতু বইটা আমি পড়িনি এবং সাহিত্যেও আমার প্রথাগত পড়াশোনা নেই, তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। বাংলা বা অন্য কোনও ভাষার সাহিত্যের অধ্যাপকরাই এর উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু এমন একজন অনুসন্ধিৎসু মানুষ আমার পাঠক, জেনে ভাল লাগল।
উবুদশ পত্রিকার সিদ্ধার্থরঞ্জন চৌধুরী সরস মন্তব্য করেছেন বাংলা-ইংরেজি মেশানো ভাষার ব্যবহার নিয়ে। আবারও ভাল লাগল, নামী লিটল ম্যাগাজিনের সিরিয়াস মানুষেরা এই ব্লগটি পড়ছেন দেখে। তাঁকে আমার বিনীত প্রশ্ন: আমার লেখায় ‘জগাখিচুড়ি’ ভাষা নেই তো? সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে গেছে যে চিঠিটি, তার কথা বলি। উচ্চারণ বিষয়ে আমার লেখাটির কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন ওড়িশার একজন বাঙালি অধ্যাপক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্টিটিউট অব মিনারেল অ্যান্ড মেটেরিয়ালস টেকনোলজির অধ্যাপক শ্রীপর্ণা চ্যাটার্জি একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘আমি এখন ওড়িশাবাসিনী। তাই সেই ব্যক্তির হয়ে আপনার কাছে মার্জনা চাইছি।’’ চিঠিটা পড়ে থমকে ছিলাম অনেক ক্ষণ। মনে হয়েছিল, আজও মনে হচ্ছে, এমন বড় মাপের মানুষেরা আছেন বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। এখনও।
আপনাদের সকলের চিঠি পেয়েই ভাল লেগেছে। আর আপনারা চিঠি লেখায় মনে হয়েছে, আমার কথাগুলো তাহলে একতরফা হয়নি। আপনাদের ছুঁতে পেরেছি। আমাদের সংযোগটা হয়েছে। এটা খুব জরুরি। যখনই আমরা কিছু বলতে চাই, কমিউনিকেট করতে চাই, তখনই আমাদের অন্য প্রান্তে এসে দাঁড়ান আর একজন মানুষ। কিংবা একাধিক মানুষ। সেই সব মানুষকে ছুঁতে গেলে যে-সেতুটা বাঁধতে হবে, তাতে সঙ্গে নিতে হবে অন্য দিকের মানুষদেরও। ‘‘একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে/গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেক জন গাবে মনে— রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রোতারা যদি আমার কথার সঙ্গে, আমার পরিবেশনার সঙ্গে একাত্মবোধ না করে তাহলে সেতু বাঁধার কাজটা সম্পূর্ণ হয় না।
আবৃত্তির ক্ষেত্রে আমরা সংযোগসাধন বা কমিউকেশনের কাজটা করি কবিতার মাধ্যমে। সেই কমিউনিকেট করার জন্য, যে কথাটা শুরুতে বলেছি, সেই কথাটাই আবার মনে করিয়ে দিতে চাই—কবিতাকে খুব ভাল করে বুঝতে হবে। কবিতার সঙ্গে একেবারে একাত্ম হয়ে যেতে হবে। কবিতার কথাগুলো যেন মনে হয় আমারই কথা। কবিতার একেবারে ভেতরে বসে উচ্চারণ করতে হবে কবিতাকে। এই প্রসঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী খুব সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়েছেন। ব্রিটিশ আমলে একদল জমিদার ছিলেন যাঁরা কলকাতায় বসে গ্রামের জমিদারি দেখাশোনা করতেন। আর এক দল ছিলেন যাঁরা জমিদারির ভেতরে বসেই জমিদারির দেখাশোনা করতেন। তেমনই একদল শিল্পী আছেন, যাঁরা গান করেন বা কবিতা বলেন শুধুমাত্র টেকনিক্যাল স্কিল কাজে লাগিয়ে। তাঁরা শিল্পের বাইরে বসে শিল্প পরিবেশন করেন। ঠিক অনুপস্থিত জমিদারের মতো। আর এক দল শিল্পী আছেন যাঁরা শিল্পচর্চা করেন শিল্পের ভেতরে বসে। এঁরাই সত্যিকারের শিল্পী। এই পুরো তুলনাটাই নীরেন্দ্রনাথের, আমার নয়।
পাশ্চাত্য তত্ত্ব বলে, কমিউনিকেশনের তিনটি উপকরণ—লোগোস (যুক্তি, আমি কী বলছি), প্যাথোস (আবেগ, আমি কী ভাবে বলছি) আর ইগোস (আমার সত্তা, আমি কে বলছি)। কবিতা বলার সময় কবিতার যত ভেতরে ঢুকবেন ততই বক্তব্য আর আবেগটা সত্যি হয়ে উঠবে। আর ধীরে ধীরে আপনার স্বতন্ত্র সত্তাটিও তৈরি হয়ে উঠবে। তবে এখানেও একটা বিপদ আছে। পরিচিতি তৈরি হয়ে গেলে ইথোস নিয়ে থেকে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। এই ইগোসকে অতিক্রম করে নিজের অনুসন্ধিৎসা আর অনুসন্ধানকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। না হলে বিপদ!
কবিতা, নাটক, গান, ছবি—যাই হোক না কেন, যে কোনও শিল্পচর্চা, ক্লাসিকের চর্চা আমাদের একটা সুন্দরের দিকে নিয়ে যায়। যত চর্চা করব, তত আমরা দেখব বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ভাবে একই কথা বলেছেন। মানুষের মূল ভাবনার জায়গাটা এক। আপাত ভিন্নতা তখন আর আমাদের অসহিষ্ণু করবে না। আবৃত্তির চর্চা করে আমরা সবাই হয়তো বড় আবৃত্তিশিল্পী হব না, কিন্তু কবিতাকে উপলব্ধি করলে আমরা সবাই সুন্দরের দিকে এক পা এগিয়ে যাব।
সুন্দরের এই অন্বেষণ এক অনন্ত যাত্রা। এবং একক যাত্রা। নিজের পথ নিজে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যাওয়া। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের একেবারে শেষের অংশ থেকে কিছুটা আজ বলতে ইচ্ছে করছে আপাত ভাবে এক শেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে। ‘‘পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন,—মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি...পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে...চল এগিয়ে যাই।’’
আবৃত্তির ক্লাসরুমের এই শেষ পর্ব আসলে এক নতুন যাত্রাপথের সূচনা।
আবৃত্তির ক্লাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে আপনার? সরাসরি জেনে নিন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। bratatiblog@gmail.com-এ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy