Advertisement
১৮ মে ২০২৪

ইংরাজি ‘love’ আর বাংলা ‘লাভ’ এক নয়

উচ্চারণ শেখালেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়বিভিন্ন ওয়ার্কশপে যখন যাই, সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন আসে উচ্চারণ নিয়ে। ‘বন’ না ‘বোন’, ‘বন্যা’ না ‘বোন্যা’, ‘অতুলপ্রসাদ’ না ‘ওতুলপ্রসাদ’, ‘ব্যতিক্রম’ না ‘বেতিক্রম’— এই সব। এই প্রশ্নগুলো আসে, কেননা বাংলাভাষায় অক্ষরের উচ্চারণগুলো খুব নির্দিষ্ট নয়।

ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়

ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:২০
Share: Save:

বিভিন্ন ওয়ার্কশপে যখন যাই, সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন আসে উচ্চারণ নিয়ে। ‘বন’ না ‘বোন’, ‘বন্যা’ না ‘বোন্যা’, ‘অতুলপ্রসাদ’ না ‘ওতুলপ্রসাদ’, ‘ব্যতিক্রম’ না ‘বেতিক্রম’— এই সব। এই প্রশ্নগুলো আসে, কেননা বাংলাভাষায় অক্ষরের উচ্চারণগুলো খুব নির্দিষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে একটা গল্প দিয়ে শুরু করি।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একটি বই আছে— ‘পথচলতি’। তাঁর বিদেশবাসের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। সেখানকার একটা গল্প। লেখক তখন জার্মানিতে। রবীন্দ্রনাথ সদ্য নোবেল পেয়েছেন। ইউরোপে তখন তাঁকে নিয়ে হইচই। কিছু মানুষ মুগ্ধ, কিছু মানুষ ক্ষুব্ধও। এই রকম অবস্থায় লেখক একদিন শুনলেন, এক জায়গায় একদল লোক ‘রাবিনড্রোনাট টাগোরে! রাবিনড্রোনাট টাগোরে’ বলে চেঁচাচ্ছে। একটু কৌতূহলী হয়ে তিনি গেলেন কী হয়েছে জানতে। গিয়ে শুনলেন, প্রত্যেকটি লোকই যথেষ্ট পরিমাণ মদ খেয়েছে। কিন্তু তাদের দাবি তারা কেউই মাতাল হয়নি, তারা আরও খেতে পারে। দোকানদার রাজি হচ্ছে না। তখন তারা ঠিক করেছে, তারা একটি শক্ত শব্দ বেছে নিয়ে উচ্চারণ করবে। যদি তারা শব্দটা ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারে, তবে ধরে নিতে হবে তারা ঠিক আছে। সেই শক্ত শব্দ হিসেবে তারা বেছেছে ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর’ নামটিকে। এই ঘটনাটি লিখে লেখক মন্তব্য করেছেন, যে-ভাষায় ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়িকে বলে ‘pferdstrasseisenbahnwagen’, সেই ভাষার মানুষদের কাছে ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর’ যে কেন শক্ত শব্দ মনে হল কে জানে!

তা সে ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়িকে যাই বলুক, জার্মান ভাষার যেটা সবচেয়ে বড় সুবিধা তা হল, ভাষাটা খুব ফোনেটিক। প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ নির্দিষ্ট। সংস্কৃত ভাষাতেও তাই। ‘সবিশেষ’ শব্দে স, শ আর ষ-এর আলাদা উচ্চারণ। বাংলায় তা নয়। বাংলায় ‘স’-এর উচ্চারণ কখনও ‘স’এর মতো, কখনও ‘শ’র মতো। ‘শ’-এর উচ্চারণও তাই। ‘এ’ কখনও ‘এ’র মতো, কখনও ‘অ্যা’র মতো। ‘অ’ কখনও ‘অ’ আবার কখনও ‘ও’। এগুলো আবার আঞ্চলিক ভাবে বদলে যায়। সব মিলিয়ে শুরু হয় বিভ্রান্তি। আর তাই ওয়ার্কশপে ওই প্রশ্নগুলো ওঠে।

কলকাতায় এখন যে ভাবে কথা বলা হয়, বাংলার সেই উচ্চারণটাকেই পরিশীলিত শুদ্ধ উচ্চারণের মাপকাঠি ধরা হয়। আমরা তাকে বলি মান্য বাংলা। বাংলাদেশেও এই উচ্চারণটি গ্রাহ্য। ওদেশে এটাকে বলে প্রমিত বাংলা। এই উচ্চারণটাই রেডিও বা টিভিতে ব্যবহার করা হয়। আমরা আজকের আলোচনাটা এর ভিত্তিতেই করব।

ওয়ার্কশপের প্রশ্নগুলোতে ফিরে আসি। বিশদে সব উত্তর দেওয়ার অবকাশ এখানে নেই। একটু ছোট ছোট করে ধরিয়ে দিই। অ দিয়ে শুরু করি। শব্দের শুরুতে ‘অ’ থাকলে এবং তার পরে ‘উ’ বা ‘ই’কার থাকলে অনেক সময়ই সেটা ‘ও’ হয়। যেমন—অতিশয়, অতিরিক্ত, অত্যুজ্জ্বল। কিন্তু ‘না’ অর্থে যখন ‘অ’ বসে তখন সেটা সব সময়ই ‘অ’। যেমন অনন্য, অনিবার্য, অসাধারণ, অকারণ, এমন সব শব্দ। কলকাতার উচ্চারণ মেনে চললে আমরা বলব ‘বোন’ (অরণ্য অর্থে), ‘কোন্যা’,‘ মোন’। তবে ‘মোঞ্চ’ নয়, মঞ্চ। আবার ‘সোদ্য’, ‘পোদ্য’, ‘গোদ্য’। অনেক সময় উচ্চারণ দিয়ে অর্থের তফাতও করা হয়। যেমন, ‘ওন্য’ মানে অপর, আর ‘অন্ন’ মানে ভাত। ‘শোয্যা’ মানে বিছানা, ‘সজ্জা’ মানে সাজ। ‘ওক্ষর’ মানে বর্ণ, আর অক্ষর মানে যা ক্ষরিত হয় না। একই ভাবে ‘ব্যালা’ মানে সময়, আর ‘বেলা’ মানে তীর। ‘সকালব্যালা’, কিন্তু ‘বেলাভূমি’। ‘ব্যতিক্রম’ না ‘বেতিক্রম’— প্রশ্নটি মাঝে মাঝেই পাই। আমরা ‘বেতিক্রম’, ‘বেতীত’ এরকমই বলি।

এই প্রসঙ্গে ‘ঋ’এর কথা বলি। ঋ মানে খুব নরম স্বভাবের অক্ষর। একটা অক্ষরের পায়ের কাছে চুপ করে বসে থাকে। আর উচ্চারণটা এমনই নরম যে, জিভটা আলতো করে তালুতে ছুঁয়ে যায়। অ-মৃত, অম্ মৃত নয়। প্র-কৃতি, প্রক্ কৃতি নয়। আ-বৃত্তি, আব্ বৃত্তি নয়। এটা খুব সাধারণ ভুল। বেশির ভাগ মানুষই ‘আব্ বৃত্তি’ করেন। অনেকে অবশ্য ‘আব্ বৃতি’ও করেন। আপনারা যারা ব্লগটা পড়ছেন, তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা আবৃত্তিই করবেন। ‘আব্ বৃত্তি’ বা ‘আব্ বৃতি’ নয়। ঋ-স্বরের উচ্চারণ কিন্তু বাংলায় একেবারে নির্দিষ্ট।

এ রকমই নির্দিষ্ট ‘শ’ আর ‘ভ’-এর উচ্চারণ। দুটোই ওষ্ঠবর্ণ। উচ্চারণের সময় উপরের ঠোঁট নীচের ঠোঁটকে স্পর্শ করবে। শুধু দাঁতটা আলতো করে নীচের ঠোঁটে ছোঁয়ালে হবে না। ওটা ইংরাজি এফ-এর উচ্চারণ। বাংলা ‘ফুল’ আর ইংরেজি ‘full’ বা ‘fool’ আলাদা উচ্চারণ। তেমনই আলাদা ইংরেজি ‘love’ আর বাংলা ‘লাভ’। ইংরেজির ‘ভি’তেও ‘এফ’-এর মতোই দাঁতটা আলতো করে নীচের ঠোঁট স্পর্শ করে শুধু। বাংলায় কিন্তু ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁটের ছোঁয়া লাগবে। ইংরেজি ‘ph’ আর ‘bh ’-এর উচ্চারণ বাংলার ‘ফ’ আর ‘ভ’-এর মতো।

‘র’, ‘ড়’ আর ‘ঢ়’-এর উচ্চারণ বাংলায় আলাদা। ‘র’ খুব নরম, ‘ড়’ একটু ধাক্কা দেয় মুর্ধায়, ‘ঢ়’ আরও বেশি ধাক্কা দেয়। জীবনানন্দের পঙক্তি ‘পাখীর নীড়ের থেকে খড়, হাঁসের নীড়ের থেকে খড় ছড়াতেছে/ মনিয়ার ঘরে রাত শীত আর শিশিরের জল’— উচ্চারণ করুন, তফাত বুঝতে পারবেন। ‘শ’, ‘ষ’, ‘স’-এর নির্দিষ্ট উচ্চারণ বাংলায় নেই। বাংলায় আমরা ‘শ’ আর ‘স’ দুটোই উচ্চারণ করি। যখন ‘স’ বা ‘শ’ স্বরবর্ণের সঙ্গে থাকে তখন সে ‘শ’। যেমন—‘শাক্ষর’, ‘শময়’, ‘শেষ’। আর যখন যুক্তাক্ষরে থাকে তখন ‘স’। যেমন—‘স্রাবণ’, ‘স্রবণ’, ‘স্নান’। ব্যতিক্রমও আছে। যেমন ‘প্রশ্ন’, ‘প্রস্ন’ নয়। ‘শুস্মিতা’, ‘সুস্মিতা’ নয়। ‘স’ বা ‘শ’-এর পরে ত, থ, দ, ধ, অথবা চ, ছ, জ, ঝ থাকলে উচ্চারণটা ‘স’-এর মতো হয়ে যেতে চায়। এটা কিন্তু ঠিক নয়। যেমন, ‘আসতে আসতে দেখলাম তুমি বাড়ি ঢুকে গেলে’ অনেক সময়ই এটা ‘আস্তে আস্তে’ হয়ে যায়। অনেককে গাইতে শুনেছি, ‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক, বেস্ত’। এগুলো কিন্তু সচেতন ভাবে উচ্চারণ করতে করতে ঠিক করে নেওয়া যায়। একবার কি বলার চেষ্টা করবেন ‘আমি আসতে আসতে দেখলাম লোকটা কাস্তে হাতে কাশতে কাশতে চলে গেল।’

এক রকম লেখা, আর এক রকম উচ্চারণ—এ সমস্যা বাংলার একার নয়। বেশির ভাগ ভাষারই আছে। একবার একটা ভ্রমণকাহিনিতে পড়েছিলাম—কার লেখা মনে নেই—লেখক টিকিট কাউন্টারে গিয়ে সে দেশেরই জায়গা প্রাসলিন আইল্যান্ডের টিকিট চেয়েছিলেন। টিকিট বিক্রেতা বললেন, এ রকম কোনও জায়গার নাম তিনি শোনেনি। লেখক শেষে কাগজ-কলম বের করে বানান করে লিখলেন ‘PRASLIN ISLAND’। টিকিট বিক্রেতা বললেন, ‘‘ও! প্রালেঁ আইল্যান্ড? তাই বলুন।’’ বুঝুন ব্যাপার! ইংরেজিও কি কিছু কম যায়? কোনও এক সাহিত্যিক, সম্ভবত বার্নাড শ বলেছিলেন, ‘Fish’ লিখতে গিয়ে ‘ghoti’ লিখলেও চলে। কেন জানেন? ‘laugh’-এর gh-এর উচ্চারণ ‘ফ’, ‘woman’ শব্দে ‘o’-এর উচ্চারণ ‘ই’, আর ‘station’-এ ‘ti’-এর উচ্চারণ ‘শ’। তাহলে কী দাঁড়াল? ‘ghoti’ = ফ+ই+শ = ফিশ। অর্থাৎ ঘটির মধ্যে মাছ।

আপাতত ঘটির মধ্যে মাছ রেখেই আমরা শেষ করি। উচ্চারণ নিয়ে আরও কথা পরের সংখ্যায় হবে।

আবৃত্তির ক্লাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে আপনার?
সরাসরি জেনে নিন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। bratatiblog@gmail.com-এ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE