Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
বিশ্ব জুড়ে ধস শেয়ার বাজারে, উদ্বেগ ভারতের, পড়ল ডলারে টাকার দামও

গ্রিসের সঙ্কট গড়াতে পারে ট্র্যাজেডিতে

‘মারা যাওয়ার ভয়ে আত্মহত্যা’। চরম অর্থ সঙ্কট সত্ত্বেও ইউরোপের দেওয়া ত্রাণ প্রকল্পের প্রস্তাব গ্রিস একবাক্যে মেনে না-নেওয়ায় তাদের প্রতি এই মন্তব্যই ছুড়ে দিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জাঁ ক্লদ জুঙ্কার। সরকারি খরচ কমিয়ে ও কর চাপিয়ে জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে গ্রিসের বামপন্থী প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের এই সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ তকমা দিয়েছে ক্ষুব্ধ ইউরোপীয় ঋণদাতারাও।

গ্রিসে বন্ধ ব্যাঙ্কের দরজা। অপেক্ষায় পেনশনপ্রাপক। ছবি: এএফপি।

গ্রিসে বন্ধ ব্যাঙ্কের দরজা। অপেক্ষায় পেনশনপ্রাপক। ছবি: এএফপি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৫ ০২:১৯
Share: Save:

‘মারা যাওয়ার ভয়ে আত্মহত্যা’।

চরম অর্থ সঙ্কট সত্ত্বেও ইউরোপের দেওয়া ত্রাণ প্রকল্পের প্রস্তাব গ্রিস একবাক্যে মেনে না-নেওয়ায় তাদের প্রতি এই মন্তব্যই ছুড়ে দিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জাঁ ক্লদ জুঙ্কার। সরকারি খরচ কমিয়ে ও কর চাপিয়ে জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে গ্রিসের বামপন্থী প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের এই সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ তকমা দিয়েছে ক্ষুব্ধ ইউরোপীয় ঋণদাতারাও। কারণ, এর পরিণতিতে গ্রিসের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হচ্ছে। তাদের আর্থিক ত্রাণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ আজই। আইএমএফের ১৬০ কোটি ইউরোর ঋণ শোধের সময়সীমাও ছিল আজ, যা মেটাতে পারবে না গ্রিস। তার আগে সোমবার থেকেই সপ্তাহ জুড়ে ব্যাঙ্ক, শেয়ার বাজার বন্ধ করা হয়েছে। ভেঙে পড়া অর্থনীতিতে জীবন দুর্বিষহ সাধারণ মানুষের। বিশ্ব জুড়ে ধস নেমেছে শেয়ার বাজারে, পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে উদ্বিগ্ন ভারত সরকার। সম্ভাব্য ‘গ্রিক ট্র্যাজেডি’ নিয়ে অর্থ মন্ত্রকের আশঙ্কা, এই ঘোরালো সঙ্কটের জেরে ভারতের শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি পুঁজি বেরিয়ে যেতে পারে।

উল্লেখ্য, করের বোঝা কমানো, ছাঁটাই না-করা ইত্যাদি প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় আসেন সিপ্রাস। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, তাঁর একগুঁয়ে মনোভাব আখেরে গ্রিক জনগণের ক্ষতিই করবে। বাদবাকি ইউরোপ মনে করছে গ্রিসের আর্থিক সঙ্কট সম্ভবত ট্র্যাজেডি-র দিকেই এগোচ্ছে এবং সেই নাটকের শেষ অঙ্ক কার্যত শুরু হয়ে গিয়েছে সোমবার থেকে।

দোটানার জেরেই ৫ জুলাই ত্রাণ প্রকল্পের শর্ত মানা নিয়ে গণভোটের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবং নিজে ত্রাণ প্রকল্প মেনে নেবেন না বলে জানিয়ে জনগণকেও বিপক্ষে মত দিতে কার্যত আর্জি জানিয়েছেন তিনি। কারণ, তাঁর মতে টানা পাঁচ বছর মন্দায় জেরবার গ্রিসকে বাড়তি কর চাপাতে বলা মানে জনগণকে ‘অপমান’ করা। ইতিমধ্যেই দেশে বেকারত্ব চরমে। তবে জুঙ্কারের মতে প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত এত দিন ধরে গ্রিসকে ত্রাণ দিয়ে অক্সিজেন জুগিয়ে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। তিনি গণভোটে ত্রাণ প্রকল্প মেনে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ‘‘হয় গ্রিস ‘হ্যাঁ’ বলুক, নয়তো মুদ্রা হিসেবে বিদায় জানাক ইউরোকে।’’ আর, জার্মানির চান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল কিছুটা সুর নরম করে এখনও রফার প্রস্তাব দিলেও বলেছেন, গণভোটের ফল দেখে তবেই নতুন করে কথা শুরু করা যেতে পারে।

নগদের অভাবেই মূলধন নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রিস। সোমবার থেকে টানা ছ’দিন ৬ জুলাই পর্যন্ত ব্যাঙ্ক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা, যার জেরে অর্থ ও পেনশন তুলতে না-পেরে নাজেহাল সাধারণ মানুষ, যদিও পেনশনকে রাখা হয়েছে নিয়ন্ত্রণের আওতার বাইরে। পেনশন পাওয়ার নির্দিষ্ট দিন ছিল সোমবারই। প্রতিদিন এটিএম থেকে ৬০ ইউরো-র বেশি তোলা যাবে না। সপ্তাহ জুড়ে বন্ধ থাকছে শেয়ার বাজারও। এ দিকে বাজারে পেট্রোল ও ওষুধ সরবরাহে টান পড়ার আশঙ্কাও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দর ব্যারেলে নেমেছে ৬২ ডলারের নীচে, যা গত তিন সপ্তাহে সবচেয়ে কম।

সিপ্রাস গণভোটের ডাক দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ঋণদাতারা নগদের জোগান বজায় রাখা নিয়ে বন্ধ করেছেন আলোচনার দরজা। যার জেরে ৬০০ কোটি ইউরো-র জরুরি অনুদান দেওয়ার আর্জিও ফিরিয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় শীর্ষ ব্যাঙ্ক। তবে গ্রিক ব্যাঙ্ককে সামান্য কিছু তহবিল তারা ৫ জুলাইয়ের গণভোট পর্যন্ত জোগাবে।

গ্রিসের মোট ২৪ হাজার কোটি ইউরোর বিপুল ত্রাণ প্রকল্পে দফায় দফায় ঋণ দিয়ে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন সদস্য দেশ, ইউরোপীয় শীর্ষ ব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার। এ দিনই আইএমএফকেও ১৬০ কোটি ইউরো মেটানোর কথা ছিল গ্রিসের। জুলাইয়ে শোধ করতে হবে আরও বড় অঙ্ক। ফলে ঋণদাতাদের কাছ থেকে এই মুহূর্তে ৭২০ কোটি ইউরোর আর্থিক ত্রাণ না-পেলে এই অর্থ মেটানো গ্রিসের পক্ষে সম্ভব নয়। গ্রিসকে বাঁচাতে এই কারণেই আগামী ৫ মাসে ১২০০ কোটি ইউরো দেওয়ার প্রস্তাব আনে ইউরোপ। তার মধ্যে ১৮০ কোটি ইউরো তারা এখনই দিতে রাজি ছিল, যা দিয়ে আইএমএফের প্রাপ্য মেটাতে পারত গ্রিস। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা ত্রাণের অর্থ না-পেলে শীঘ্রই নগদের অভাবে সরকারি খরচ মেটাতে পারবে না গ্রিস। শেষ পর্যন্ত যার জেরে ইউরোপ থেকে বেরিয়ে যেতে হতে পারে দেউলিয়া গ্রিসকে। তা হলে ইউরোর বদলে দুর্বল নিজস্ব মুদ্রা চালু করতে হবে, যা দিয়ে আমদানি-নির্ভর গ্রিস পণ্য কিনতে পারবে না।

সোমবার ইউরোপ-আমেরিকা, এশিয়ার শেয়ার বাজারে সব সূচকের মুখই ছিল নীচের দিকে। ভারতে সেনসেক্স পড়েছে ১৬৬.৬৯ পয়েন্ট। দাঁড়িয়েছে ২৭,৬৪৫.১৫ অঙ্কে। এক সময়ে অবশ্য সেনসেক্স নেমেছিল প্রায় ৬০০ পয়েন্ট। পরে পড়তি বাজারে বহু লগ্নিকারী শেয়ার কেনায় ওঠে সূচক। ইউরোপে জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনে সূচকের পতন ১.৬৮% থেকে ৩.৩১%। ডলারে টাকা নামে ২০ পয়সা। এক ডলার হয় ৬৩.৮৪ টাকা।

এ দিন বিপদ বুঝে নরেন্দ্র মোদী সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। এখনও অবশ্য কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি হয়নি। তাই শুধু ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে লগ্নিকারীদের স্নায়ু শান্ত রাখার চেষ্টা করেন অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা। লগ্নিকারীদের আশ্বস্ত করে কেন্দ্রীয় অর্থসচিব রাজীব মহর্ষি বলেন, ‘‘গ্রিসের ঘটনার সরাসরি প্রভাব ভারতে পড়বে না।’’ কিন্তু ইউরো ঋণপত্র বা বন্ড খাতে পাওয়া রিটার্ন বাড়তে থাকলে ভারত থেকে বিদেশি লগ্নি বেরিয়ে যেতে পারে। মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমও দাবি করেন, খুব বড় ধাক্কা ভারতে লাগবে না। রফতানিতেও বিশেষ প্রভাব পড়বে না বলেই বাণিজ্য সচিব রাজীব খেরের দাবি। তাঁর যুক্তি, গ্রিসে খুব একটা ভারতীয় পণ্য রফতানি হয় না। তবে সামগ্রিক ভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানি কিছুটা কমতে পারে।

কেন গণভোট?

• ত্রাণ প্রকল্পের অর্থ পেতে সব শর্ত মানবে গ্রিস? নাকি বেরিয়ে যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে? এ নিয়ে দেশবাসীর মতামত জানা।

মত জানতে প্রশ্ন কী?

• ঋণদাতাদের শর্ত কি মেনে নেওয়া হবে?

পক্ষে: হ্যাঁ, বিপক্ষে: না।

মানে কী?

• হ্যাঁ হলে ত্রাণ পাবে গ্রিস। কিন্তু কর বাড়িয়ে, সরকারি খরচ কমিয়ে মানতে হবে শর্ত।

• না হলে ইউরোপ থেকে বিদায় নেবে দেউলিয়া গ্রিস। মুদ্রা হিসেবে ছাড়তে হবে ইউরোকে।

ভোট কেমন পড়বে?

• ৪০ শতাংশের বেশি মানুষকে মত দিতে হবে। ব্যাঙ্ক বন্ধে জেরবার নাগরিকরা কত জন ভোট দিতে যাবেন, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।

শেষ কবে গণভোট হয়?

• ১৯৭৪ সালে। রাজতন্ত্র তুলে দেওয়া নিয়ে। ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ প্রজাতন্ত্রের পক্ষে মত দেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Global markets Monday Globe Stocks finance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE