ক্রেতা নেই। তাই কাজও তেমন এগোয়নি। বেগতিক বুঝে বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (সেজ) তৈরির বরাত ফিরিয়েই নেওয়ার আর্জি জানিয়েছিলেন নির্মাতারা। সেই অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে পাঁচটি সেজ-এর অনুমোদন বাতিল করে দিল কেন্দ্র। যা ফের স্পষ্ট করে দিয়ে গেল শিল্পে এ রাজ্যের মলিন ভাবমূর্তি আর লগ্নি টানার ক্ষেত্রে তার দৈন্যদশাকে।
২৮ এপ্রিল বৈঠকে মোট পাঁচটি সেজ-এর অনুমোদন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের বোর্ড অব অ্যাপ্রুভালস। যার সব ক’টির ঠিকানাই পশ্চিমবঙ্গ। এর মধ্যে চারটি তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য চিহ্নিত ছিল। বাকিটি চর্মশিল্পের। কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রে খবর, সেজগুলি তৈরিতে সায় পাওয়ার পরেও প্রকল্পের কাজ তেমন এগোয়নি। কেন, তার সদুত্তরও দিতে পারেননি সেজ নির্মাতারা। সেই কারণে এই সিদ্ধান্ত।
কিন্তু প্রকল্পগুলির নির্মাতাদের পাল্টা দাবি, শিল্পে রাজ্যের ভাবমূর্তি তলানিতে ঠেকেছে আজ বহু দিন। বড় কল-কারখানায় টাকা ঢালা তো দূর অস্ত্, ছোট-মাঝারি প্রকল্প কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও লগ্নি করতে আসতে চাইছেন না কেউ। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে সেজ গড়ব কার জন্য? কে বিনিয়োগ করবে সেখানে?’’ অথচ কী অদ্ভূত বৈপরীত্য! দেশে প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি সেজ হয়েছিল এ রাজ্যেই।
এক শিল্প কর্তা বলছিলেন, ‘‘অনুমোদন খারিজ হওয়া সেজ আর হওয়ার জো নেই। কিন্তু শিল্পে রাজ্যের তলানিতে ঠেকা ভাবমূর্তি শোধরাতে নতুন সরকারের দিকে চেয়ে আমরা।’’ তাঁরা চাইছেন, এ বার অন্তত জমি-নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছুতমার্গ কাটুক সেজ নিয়ে। হিল্লে হোক সিন্ডিকেট-সমস্যারও। নতুন সরকারের মাথা হিসেবে ‘নতুন’ মমতাকেও দেখতে চান তাঁরা।
বাতিল হয়ে যাওয়া সেজ-এর তালিকায় নাম রয়েছে অ্যাবেক্স ইনফোকমের। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কাশিপুরে তাদের তথ্যপ্রযুক্তি সেজ তৈরির কথা ছিল। অনুমোদন মিলেছিল ২০০৭ সালে। প্রথমে প্রকল্প আটকে থাকার কারণ ছিল বিশ্বজোড়া মন্দা। কিন্তু তারপরে অন্যান্য রাজ্যে লগ্নি-পরিস্থিতির উন্নতি হলেও, এ রাজ্যে উত্তরোত্তর তার অবনতি হয়েছে বলে সংস্থাটির অভিযোগ। ফলে থমকে গিয়েছে প্রকল্প। আটকে গিয়েছে রাজারহাটে ওরিয়ন আইটি পার্ক, বাসন্তী হাইওয়েতে সালারপুরিয়া প্রপার্টিজ আর আসানসোলে বেঙ্গল সৃষ্টি ইনফ্রাস্ট্রাকচার্সের সেজও। এই তিন তথ্যপ্রযুক্তি সেজই ছাড়পত্র পেয়েছিল ২০০৮ সালে। চারটিতে মিলিত জমির পরিমাণ ৫০ একরের বেশি। তালিকার শেষ নাম— এম এল ডালমিয়ার বানতলা শিল্পতালুকের একাংশ। যা সেজ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল চর্মজাত পণ্য (ব্যাগ, জুতো ইত্যাদি) রফতানির লক্ষ্যে।
এই সমস্ত সেজ-এরই নির্মাতার অভিযোগ, রাজ্যের যা ভাবমূর্তি, তাতে টাকা ঢালতে আসছেন না কেউ। শিল্পমহলের একাংশের ক্ষোভ, যেখানে জমিতে ইঁট পড়ার আগে রাস্তা আগলে দাঁড়ায় সিন্ডিকেট, সেখানে কেউ বিনিয়োগ করবেন কোন সাহসে? তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে লগ্নির আশায় চারটি সেজ গড়তে জমি কেনা হলেও, সেখানে প্রত্যাশার সিকি আনা বিনিয়োগও আসেনি।
এক শিল্প কর্তার ক্ষোভ, ‘‘সেজ-জটে এখনও রাজ্যে আসতে পারেনি ইনফোসিস। আটকে উইপ্রোর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস। এখানে এখনও পা রাখেনি ওর্যাকল, গুগ্ল, মাইক্রোসফট-এর মতো তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিকও। কাজেই অফিসের জায়গা নির্মাতারা কার কাছে বিক্রি করবে?’’
কিছু দিন আগে এ দেশে সফটওয়্যার বহুজাতিক ওর্যাকল-এর ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনায় রাজ্যের ঠাঁই না পাওয়ার সময়েও এ ভাবেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল শিল্পমহল। তাদের অভিযোগ ছিল, সেজ বিরোধী অবস্থান, ইনফোসিস-উইপ্রোকে জমি দেওয়া ঘিরে বিতর্ক, তথ্যপ্রযুক্তি হাব রাজারহাটে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য আর সার্বিক ভাবে লগ্নি টানা এবং তা ধরে রাখায় মলিন ভাবমূর্তি। এই সব কিছুর খেসারতই দিতে হচ্ছে রাজ্যকে।
অনেক শিল্পকর্তাই ঠারেঠোরে বলছেন, বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের মঞ্চ থেকে গালভরা লগ্নি-প্রস্তাবের অঙ্ক ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এক সময়ের গর্বের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পেও এখন পশ্চিমবঙ্গকে তুড়ি মেরে টপকে যাচ্ছে অনেক পরে দৌড় শুরু করা রাজ্যগুলি। দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বই অনেক দিনই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কলকাতাকে এখন হেলায় টপকে যাচ্ছে অনেক পিছন থেকে উঠে আসা তিরুঅনন্তপুরম, বিশাখাপত্তনম, কোচি, বিজয়ওয়াড়ার মতো শহরও।
ক্ষুব্ধ শিল্পমহলের দাবি, যে রাজ্যে স্রেফ সেজ নিয়ে ছুতমার্গের কারণে ইনফোসিস জমি পায় না, জমি-জটে বিদায় নেয় ন্যানো সেখানে লগ্নি আসবে কোথা থেকে? বণিকসভার এক কর্তার ক্ষোভ ছিল, ‘‘যে রাজ্যে রতন টাটাকে পাগল বলে অসম্মান করা হয়, সেখানে লগ্নিকারী পা রাখবেন কোন সাহসে?’’
তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ টানায় সেজ নিয়ে আপত্তি যে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা স্পষ্ট পরিসংখ্যানেও। ২০১৩-’১৪ সালে কেরল থেকে সফটওয়্যার রফতানির পরিমাণ ছিল ৭,০০০ কোটি টাকা। প্রায় ৪৩% বেড়ে ২০১৪-’১৫ সালে তা পৌঁছেছে ১০,০০০ কোটিতে। সেখানে ওই একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সফটওয়্যার রফতানি বেড়েছে ১১%। সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের দাবি, এই ফারাকের মূলে রয়েছে সেজ। কেরলে তৈরি হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ সেজ—টেকনোপার্ক। ইনফোসিস, টিসিএস, এজিস থেকে শুরু করে ওর্যাকলের মতো সংস্থা ব্যবসা করছে সেখানে। কেরলের ৬০% সফটওয়্যার রফতানিই হচ্ছে ওই সেজ থেকে।
সেখানে গত পাঁচ বছরে সেজ-এর সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে বাড়েনি। উল্টে পাঁচটি সেজ বরং এখন কমে গেল। রাজ্যে বিনিয়োগের পথে বড় বাধা জমি অধিগ্রহণে মমতা-সরকারের না করে দেওয়াও। শিল্পমহল ও বণিকসভাগুলি বারবার বলেছে অসংখ্য মালিকের সঙ্গে দর কযাকষি করে প্রকল্পের জন্য জমি কেনা কতটা কঠিন। কিন্তু তাতে সরকারের অবস্থান বদলায়নি। রাজ্যের সার্বিক ভাবমূর্তি ম্লান করার ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের দাপট এবং তোলাবাজির ভূমিকাও দিন দিন বড় হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট শিল্পের। ২০১২ সালে তোলাবাজদের অত্যাচারে জেরবার কয়েকটি সংস্থা তথ্যপ্রযুক্তি দফতরে চিঠি দিয়েছিল। এর মধ্যে ছিল ক্যাপজেমিনি, জেনপ্যাক্ট, টিসিএস, কগনিজ্যান্ট ইত্যাদি। কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ হয়নি।
এ সবের খেসারত দিয়ে লগ্নি যে আরও শুকিয়ে যাচ্ছে, তা স্পষ্ট অফিসের জন্য জায়গা (অফিস স্পেস) নেওয়ার অনীহায়। উপদেষ্টা সংস্থা জোনস লাং ল্যাসেলের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে সারা দেশে ৩৫ কোটি বর্গ ফুট অফিস-স্পেস নিয়েছে কপোর্রেট। ২০১৪ সালের তুলনায় ১৭% বেশি। মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, চেন্নাইয়ে চাহিদা বেড়েছে। ব্যতিক্রম কলকাতা। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে মাত্র ১ লক্ষ ৭০ হাজার বর্গ ফুট অফিসের জায়গা নিতে পেরেছে এই শহর। গত বছরের তুলনায় ৩২% কম। ফাঁকা পড়ে রয়েছে ৩৮ লক্ষ বর্গ ফুট অফিস তৈরির জায়গাও। বিশেষজ্ঞ সংস্থা কোলিয়ার্স ইন্টারন্যাশনালের সমীক্ষাতেই এই তথ্য উঠে এসেছে।
এক শিল্প কর্তার আক্ষেপ, ‘‘শিল্প নেই। লগ্নি অধরা। তার মধ্যে বহু দিন পর রাজ্য পাঁচে পাঁচ। তা-ও কি না সেজ অনুমোদন হারানোয়!’’ প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি সেজ তৈরির রাজ্যে এই বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়াটুকুই বাকি ছিল? নতুন প্রকল্পের গন্তব্য হিসেবে ভুবনেশ্বর, গুয়াহাটির নামও শোনা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে সেখানে শুধুই নৈঃশব্দ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy