আলোচনায় চিদম্বরম। সোমবার কলকাতায়।— নিজস্ব চিত্র
পণ্য-পরিষেবা করের (জিএসটি) হার তিনটির বেশি হলে, হারিয়ে যাবে তা চালুর মূল উদ্দেশ্য। নামকে ওয়াস্তে কর কাঠামোর সংস্কার হবে ঠিকই। কিন্তু আসলে সেটি হবে যুক্তমূল্য করের (ভ্যাট) পুরনো মদকেই নতুন বোতলে পুরে চালিয়ে দেওয়ার সামিল। সোমবার কলকাতায় এমনই মন্তব্য করে গেলেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন ও আইআইএম-কলকাতা আয়োজিত আলোচনাসভায় বক্তৃতা শেষে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘‘শূন্য থেকে ১০০ শতাংশের মধ্যে বিভিন্ন হারে কর বসিয়ে দেওয়ার নাম জিএসটি নয়। তাতে তার মূল লক্ষ্যই হারিয়ে যায়।’’ তাঁর মতে, সেটি কার্যত পুরনো ভ্যাট-কেই নতুন মোড়কে চালিয়ে দেওয়া। চিদম্বরমের পরামর্শ, জিসটি-র হার তিনটির মধ্যে বেঁধে রাখুক কেন্দ্র। একটি মূল হার। যা অধিকাংশ পণ্য-পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটি তার থেকে বেশি এবং অন্যটি কম। ইঙ্গিত স্পষ্ট, মোদী সরকার যে-ভাবে অন্তত পাঁচ রকম হারের প্রস্তাব রেখেছে, তা সঠিক পথ বলে মনে করছেন না তিনি।
উল্লেখ্য, ১৮ এবং ১৯ অক্টোবরের বৈঠকে জিএসটি-র পাঁচটি হার চালুর প্রস্তাব দিয়েছিল কেন্দ্র—
(১) আবশ্যিক খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য জরুরি পণ্যে ৬%
(২) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্যে ১২%
(৩) বিলাসবহুল ভোগ্যপণ্য (যেমন, দামি গাড়ি) ও তামাক-সিগারেট-পানমশলার মতো ক্ষতিকর পণ্যে ২৬%
(৪) সোনায় ৪%
(৫) বাকি পণ্য-পরিষেবায় ১৮%। এর উপর আবার প্রস্তাব রয়েছে দামি ভোগ্যপণ্য এবং ক্ষতিকর পণ্যের উপর আলাদা ভাবে সেস বসানোর। এ দিন স্পষ্ট করে মোদী সরকারের কথা উল্লেখ না-করলেও, এত রকম করের হারেরই সম্ভবত বিরোধিতা করেছেন চিদম্বরম।
এ দিন এই আলোচনাসভার বিষয়বস্তু ছিল ‘ভারতে আর্থিক সংস্কারের ২৫ বছর: ফিরে দেখা এবং সম্ভাবনা’। সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মাঝের এই সিকি দশকে দেশের অর্থনীতিতে ঘটে যাওয়া আমূল বদলের কথা বলেছেন ইউপিএ জমানার অর্থমন্ত্রী। ১৯৯১ সালে দরজা খুলে দেওয়ার আগে দেশের অর্থনীতির চেহারা কেমন ছিল, তা বলতে গিয়ে নিজের ছাত্রজীবনের গল্প তুলে এনেছেন কংগ্রেসের এই নেতা তথা রাজ্যসভা সাংসদ। বলেছেন, তখন স্কুটার কিনতে, বিমানের টিকিট বুক করতে এমনকী বিদেশে ফোন করতেও কী ভাবে অপেক্ষার লাইনে (ওয়েটিং লিস্ট) দাঁড়াতে হত। তাঁর মতে, সংস্কারের হাত ধরে দেশ আমূল বদলেছে। যদিও তার সুফল শহর কলকাতা বরাবর অস্বীকার করে এসেছে বলে আক্ষেপ করেছেন তিনি।
ভবিষ্যতেও সংস্কারের চাকায় গতি বজায় রাখতে একগুচ্ছ দাওয়াই দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে— রাজকোষ ঘাটতিকে যে কোনও মূল্যে ৩ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা, বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ, নিয়ন্ত্রণ ও আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের ফাঁস আলগা করা, কর আদায় বাড়ানোর পথ প্রশস্ত করা, নতুন ব্যবসা শুরুতে উৎসাহ এবং অবশ্যই দেশে সহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি করা।
তবে তাঁর মতে, এর সঙ্গে আর্থিক অসাম্য কমানোর জন্য নতুন ভাবে বেতন (মূলত অসংগঠিত কর্মীদের জন্য) ও করনীতির কথা ভাবতে হবে কেন্দ্রকে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় যে ভাবে বরাদ্দ ছাঁটাই করা হচ্ছে, তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। দেশের উন্নয়নের জন্য এই দুইয়ের পাশাপাশি পরিকাঠামোয় মোটা সরকারি বিনিয়োগও অন্যতম শর্ত বলেই চিদম্বরমের দাবি।
সহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, সমাজ সহিষ্ণু না-হলে, থমকে যেতে পারে দেশের আর্থিক প্রগতির চাকাও। তাঁর প্রশ্ন, যদি আর্থিক বৃদ্ধি বজায় থাকে, কিন্তু ধর্ম, জাতি ইত্যাদির ভিত্তিতে সমাজে ফাটল দেখা দেয়, তবে তা কি দেশের পক্ষে ভাল? চিদম্বরমের অভিযোগ, বহুত্ববাদ, বিবিধতা, নিজে বাঁচা এবং অন্যকেও শান্তিতে বাঁচতে দেওয়া— সহিষ্ণুতার এই প্রাথমিক বিষয়গুলি গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত কমছে। যা আশঙ্কাজনক।
চিদম্বরমের মতে, দেশ এবং অর্থনীতি হিসেবে যে ভারত ঝলমলে, তার কারণ তা খোলামেলা রাজনৈতিক তর্কে বিশ্বাস করে। এ দেশ আস্থা রাখে অর্থনীতি ও সমাজের দরজা-জানলা খুলে রাখায়। এই খোলা অর্থনীতি, খোলা রাজনীতি এবং খোলা সমাজের দর্শন থেকে সরে এসে অসহিষ্ণুতার পথে হাঁটলে, দীর্ঘ মেয়াদে কোনও দেশের পক্ষেই আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে তাঁর দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy