Advertisement
১৮ মে ২০২৪

কুবের উবাচ

অনেকেই বলেন, এইটুকু তো রোজগার। তাতে সব খরচ-খরচা সামলে কতটাই বা পড়ে থাকে যে জমাব?আমি বলি, রোজগার কম হলে বড় সঞ্চয় গড়ে তোলা সত্যিই কঠিন। কিন্তু কিছুটা জমানোর সুযোগ অবশ্যই থাকে।

শৈবাল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৬ ০৪:০২
Share: Save:

বিদ্যুৎ (২৪) • বাবা (৫৮) • মা (৪৮)

রাজ্য সরকারি কর্মী | | শহরতলিতে ভাড়া বাড়িতে বাস | | বাড়ি বর্ধমান, বাবা-মা সেখানে | | ডিসেম্বরে বিয়ে, লক্ষ্য তার আগে খরচ জোগাড় | | খুঁজছেন ভবিষ্যতের জন্য ভাল ভাবে সঞ্চয়ের পথ

নিট আয় (মাসে)।। ২২,০০০ ।। খরচ (মাসে)।। সংসার ও ব্যক্তিগত ৬,০০০।। সঞ্চয় (মাসে)।। জিপিএফ ২,০০০ | | | জীবনবিমা ১,০১১ | | | পিপিএফ ২৫০ | | | পিএলআই ৪০০ | | | রেকারিং ২,০০০ | | | এসআইপি ২,০০০ বাড়ি বাড়ানোর জন্য ৫,৩৩৯ | | | মিউচুয়াল ফান্ড ৩,০০০।।
সম্পদ।। পিপিএফ ৪,৫০০ | | জিপিএফ ১২,০০০ | | রেকারিং ২১,০০০ | | সেভিংস ১০,০০০ | | এসআইপি ৭,০০০ | | বাড়ি ৬,০০,০০০

অনেকেই বলেন, এইটুকু তো রোজগার। তাতে সব খরচ-খরচা সামলে কতটাই বা পড়ে থাকে যে জমাব?

আমি বলি, রোজগার কম হলে বড় সঞ্চয় গড়ে তোলা সত্যিই কঠিন। কিন্তু কিছুটা জমানোর সুযোগ অবশ্যই থাকে।

বিদ্যুৎকে দেখুন। সরকারি চাকরি। বেতন তেমন বেশি নয়। তবুও যতটুকু পারছেন, নিজের মতো করে জমানোর চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন ধরনের লগ্নি ও সঞ্চয় প্রকল্পে পুঁজি ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। কৌশলে হয়তো কিছু খামতি রয়েছে। তবে প্রাথমিক ভাবে জমানোর চেষ্টা অন্তত দেখা যাচ্ছে তাঁর মধ্যে। যেটা থাকা খুব জরুরি। আর বিন্দু বিন্দু সঞ্চয়ের ভিতের উপর দীর্ঘ মেয়াদে চোখে পড়ার মতো তহবিল তৈরি করে ফেলা খুব অসম্ভব কিছু নয়।

তিন মন্ত্র

যাঁদের বেতন কম, তাঁরা যদি বড় তহবিল তৈরি করতে চান, তা হলে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে—

• সঞ্চয়ের খাতে টাকা রাখার পরে বাদবাকি যা থাকে, তাই দিয়ে রোজকার খরচ চালানোর চেষ্টা করা। এতে দৈনন্দিন জীবনের কিছু চাহিদায় হয়তো সেই মুহূর্তে কাটছাঁট করতে হয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত ও নিশ্চিন্ত করার তাগিদে স্বল্প রোজগেরেদের সেই ত্যাগ স্বীকারের মানসিক জোর রাখাটাই আসল অস্ত্র। সঞ্চয়ের অল্প সুযোগ এ ভাবে পুষিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, লগ্নির পথটা সঠিক হওয়া চাই। এলোমেলো, ভুলভাল পথে সঞ্চয় করে গেলে রাজার ধনও কমে আসতে সময় লাগে না।

• যতটা সাধ্য, ততটা দিয়েই সঞ্চয়ের মজবুত ভিত তৈরি করতে থাকা। আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভিতের উপর ইমারত গড়ে তোলার কাজটা একটু একটু করে চালিয়ে যেতে হয়।

• নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নিজের দক্ষতা আরও বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। যাতে ভবিষ্যতে রোজগার বাড়ানোও সম্ভব হয়। আসলে কোনও রকমে একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করে নিশ্চিন্তে বসে থাকার দিন আর নেই। জীবন ক্রমশ সুরক্ষিত করে তোলার জন্য হয় বর্তমান চাকরিতে উন্নতি করতে হবে, নয়তো আরও ভাল চাকরি খুঁজে নিতে হবে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় ভরপুর চাকরির বাজারে টিকে থাকার জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলাটাও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

৩০-৩০

রোজগার বাড়ানোর উপায় সম্পর্কে বললাম। এ বার বিদ্যুতের সুবিধার জন্য ৩০-৩০ কৌশলের কথা বলি। এতে তাঁর লক্ষ্য পূরণে সুবিধা হবে।

এই কৌশলে সাধারণত ধরে নেওয়া হয়, আমরা রোজগার করার লক্ষ্যে ৩০ বছরের জন্য কাজ করব। আর সেই সঙ্গে এমন ভাবে সঞ্চয় করব, যার উপর ভর করে আরও ৩০ বছর স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করা যাবে। ফলে প্রথম ৩০ বছরে যথেষ্ট পরিমাণে তহবিল গড়ে তোলা সম্ভব না-হলে, পরের দফায় জীবন কাটানো কঠিন হয়ে পড়তে পারে। তাই প্রথম ৩০ বছর ধরে সম্পদ তৈরি করতে হবে নিখুঁত বিনিয়োগ ও সঞ্চয় পরিকল্পনা ছকে নিয়ে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন কর্মজীবনে উন্নতি করে আয় বাড়ানোও।

বিদ্যুতের বয়স মাত্র ২৪। ৩০ বছর ধরে বড় তহবিল গড়ে তোলা ও কেরিয়ারে উন্নতি, দু’টির জন্যই তাঁর সামনে অঢেল সময় ও সুযোগ পড়ে রয়েছে। শুধু ভেবেচিন্তে প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে হবে।

জীবনবিমা

বিদ্যুতের দু’টি জীবনবিমা প্রকল্প। একটি এলআইসি। আর অন্যটি হল ডাক-জীবনবিমা।

দু’টির কোনওটিই কিন্তু তাঁর পরিবারকে খুব বেশি সুরক্ষা দিতে পারবে না। কারণ, আর্থিক নিরাপত্তা নয়, সঞ্চয়ের লক্ষ্যেই প্রকল্পগুলি কিনেছেন তিনি। আর সবাই এত দিনে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন যে, জীবনবিমাকে টাকা জমানোর পথ হিসেবে দেখার ঘোরতর বিরোধী আমি। আমার মতে, এটি সংসারের অন্যতম রোজগেরে মানুষটির আকস্মিক অনুপস্থিতিতে পরিবারের ভেসে যাওয়া আটকানোর হাতিয়ার। তাই এখান থেকে রিটার্ন কতটা বেশি পাওয়া যাচ্ছে, সেটা যাচাই করতে গেলে বিমা করার প্রকৃত উদ্দেশ্যটাই মাঠে মারা যায়।

তার উপর ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ বিয়ে করতে চলেছেন। স্ত্রী যদি আর্থিক ভাবে তাঁর উপর নির্ভরশীল হন, তা হলে দায়িত্ব আরও বাড়বে। ফলে পরিবারের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁর অবশ্যই একটি টার্ম পলিসি করা উচিত। পলিসির আওতায় মৃত্যু, দুর্ঘটনা, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মতো বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করার রাইডার যেন থাকে।

পুরনো প্রকল্পগুলি অবশ্য তিন বছর টানা চালাতেই হবে। না-হলে সেগুলি ‘সারেন্ডার’ করলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ এখন প্রিমিয়াম দেওয়া বন্ধ করে দিলে এ যাবৎ দেওয়া পুরো টাকাটাই নষ্ট হবে।

রেকারিং ডিপোজিট

রেকারিং ডিপোজিটে (আরডি) সুদ এখন কমে গিয়েছে। সুতরাং রিটার্নের নিরিখে এই সঞ্চয়ের পাল্লা ভারী নয়। সেই সঙ্গে তার উপর কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। কাজেই মাত্রাতিরিক্ত আরডি মানে অন্য খাতে সঞ্চয় আরও বাড়ানোর সুযোগ হারানো। এবং বেশি রিটার্ন দেওয়ার সম্ভাবনাযুক্ত প্রকল্পগুলিকে বঞ্চিত করা। সে আপনি ডাকঘর বা ব্যাঙ্ক, যেখানেই আরডি করুন না কেন।

তাই তার বদলে বরং কোনও ডেট বা ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডে মাসে মাসে এসআইপি করা লাভজনক। তেমন হলে হাতে নগদের জোগান বজায় রাখার জন্য কিছু টাকা ফিক্সড ডিপোজিটও করে রাখা যেতে পারে। তবে তার জন্য আগে খোঁজ নিয়ে দেখুন, কোন ব্যাঙ্কে তুলনায় বেশি হারে সুদ পাওয়া যাবে।

পিপিএফ

সুদের হার সম্প্রতি কমে গিয়েছে। তবু এখনও সঞ্চয়ের জন্য আকর্ষণ ধরে রাখতে পেরেছে ডাকঘর স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্প পিপিএফ। দীর্ঘ মেয়াদে এই সঞ্চয় কিন্তু অনেক বড় সহায় হয়ে উঠতে পারে। বিদ্যুতের উচিত পিপিএফে টাকা রাখার পরিমাণ ধীরে ধীরে আরও বাড়াতে থাকা।

এসআইপি

দীর্ঘ মেয়াদে প্রায় সকলকেই এসআইপি করার পরামর্শ দিই আমি। বিশেষ করে যাঁদের একলপ্তে ঢালার মতো বাড়তি টাকা হাতে তেমন থাকে না, তাঁদের সঞ্চয় বাড়ানোর বড় অস্ত্র হতে পারে এই মাধ্যম। তবে তা করতে হবে লম্বা সময়ের জন্য। এবং তার থেকে রিটার্ন কতটা পাওয়া যেতে পারে, সেটা স্বল্প মেয়াদে যাচাই করতে বসলে চলবে না। ধৈর্য ধরে একটু একটু করে এগোতে হবে। বিন্দু বিন্দু জলে যেমন সমুদ্র তৈরি হয়, তেমনই বিদ্যুতের অল্প অল্প করে জমানো টাকা বিপুল আকার ধারণ করতে পারে ভাল কোনও শেয়ার নির্ভর (ইকুইটি) এসআইপি প্রকল্পের হাত ধরে।

শেয়ার বাজার খুব অস্থির জায়গা। সেখানে ওঠা-নামা চলতেই থাকে। সেই ঝুঁকি এড়িয়ে চোখে পড়ার মতো রিটার্ন পাওয়া সম্ভব ইকুইটি ফান্ডে দীর্ঘ মেয়াদের এসআইপি করলে।

বিদ্যুৎ লার্জ ক্যাপ (বড় সংস্থা) ও মিড ক্যাপ (মাঝারি সংস্থা) ফান্ডে টাকা ঢেলেছেন। ফান্ডগুলি ভাল রিটার্ন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

তিনি আরও দু’টো ফান্ডে লগ্নি করতে চান। আমি বলব, ডাইভার্সিফায়েড ইকুইটি ফান্ড বাছুন। বিভিন্ন শিল্পের একাধিক সংস্থার শেয়ার কেনা হয় এই ধরনের ফান্ডের তহবিল দিয়ে। এতে ঝুঁকি কম থাকে। একটি শিল্পের সংস্থা ভাল রিটার্ন দিতে না-পারলে, আর একটি শিল্পের সংস্থা অনেক সময় তা পুষিয়ে দিতে পারে।

তবে আমার পরামর্শ, যে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার কাছ থেকে ইতিমধ্যেই দু’টি ফান্ড কিনেছেন, তাদের কাছে এ বার আর না-যাওয়াই ভাল। খুঁজে দেখলে অন্য কোনও সংস্থার কাছে হয়তো আরও ভাল কিছু ফান্ড পেতে পারেন। এটাও লগ্নি ছড়িয়ে দেওয়ারই একটি কৌশল।

বাড়ি ও বিয়ে

বিদ্যুতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি কিন্তু বিয়ে করার মতো নয়। আমি ঘর বাঁধার সিদ্ধান্তকে মন্দ বলছি না। কিন্তু তার সঙ্গে যে দায়-দায়িত্ব বাড়ে, এই মুহূর্তে হয়তো স্বচ্ছন্দে তা ঘাড়ে নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই তিনি। কিন্তু ডিসেম্বরে বিয়ের সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছেন, তখন খরচ জোগাড়ের ব্যবস্থাও করতে হবে। বিয়ের জন্যই বোধহয় বর্ধমানের বাড়ি বাড়াচ্ছেন তিনি। মাসে ৫,০০০ টাকার মতো বেরিয়ে যাচ্ছে সে জন্য। জুনের মধ্যে বাড়ির কাজ শেষ করতে পারলে তারপরে সেই টাকাটা থাকবে।

বিয়ের জন্য ধােরর কথা ভেবেছেন বিদ্যুৎ। উপায় নেই। বাড়ির কাজ শেষ হলে যে-খরচ বাঁচবে, তার কিছুটা দিয়ে সেই ধার মেটানো শুরু করতে পারেন। পরে কোনও আরডি-র মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে, তা ভাঙিয়ে একলপ্তে অনেখানি ধার শোধ করে দিতে অসুবিধা হবে না।

স্বাস্থ্যবিমা

স্বাস্থ্যবিমা যে-কোনও মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলির মধ্যে অন্যতম। না-হলে চিকিৎসার পেছনে সঞ্চয়ের বহু টাকা বেরিয়ে যাবে। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষদের এ কথা মনে রাখা জরুরি। কারণ, আচমকা একসঙ্গে অনেকখানি টাকার প্রয়োজন পড়লে অথৈ জলে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আশা করব এ কথা মাথায় রেখে বিয়ের পরে বিদ্যুৎ অবশ্যই একটি স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প কিনবেন স্ত্রী ও নিজের জন্য। বাবা-মাকেও আলাদা কোনও প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে ভাল হয়। তাঁদের বয়স হয়েছে। চিকিৎসার জন্য যে-কোনও সময় বড় অঙ্কের টাকার দরকার পড়তে পারে।

অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত
(মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

income save money
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE