গত সপ্তাহে শেয়ার বাজার দেখেছে মহাপতন। শেয়ার সুনামি এখন বিশ্ব জুড়ে। ভারত এত দিন কিছুটা সামাল দিলেও এ বার আর ধরে রাখতে পারেনি। গত সপ্তাহে সেনসেক্স নেমেছে মোট ১৬৩১ পয়েন্ট।
এর আগে বেশ কয়েক বার ২৪ হাজারে নেমে আবার ঊর্ধ্বগতি পেলেও এ বার আর তা হয়নি। ভেঙে গিয়েছে ২৩ হাজারের মাত্রাও। সপ্তাহ শেষে মুম্বই সূচকের অবস্থান ছিল ২২,৯৮৬ অঙ্কে। এই অবস্থায় আতঙ্ক গ্রাস করেছে ইক্যুইটির দুনিয়াকে।
গোটা বিশ্বে যখন চলছে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, তখন ভারতের অর্থনীতি ভাল আছে বলে বারবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। স্বপ্ন দেখানো হয়েছে ৭.৬% বৃদ্ধির। কিন্তু গত কয়েক দিনে যে-সব পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বে-আব্রু হয়ে পড়েছে অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা। ডিসেম্বরে শিল্পোৎপাদন কমেছে ১.৩%। বড় রকমের পতন ঘটেছে মূলধনী পণ্য উৎপাদনে, যা শিল্পে গভীর মন্থরতার ইঙ্গিত দেয়। পাশাপাশি গাড়ি বিক্রি কমেছে জানুয়ারিতে। শিল্পের অবস্থা খারাপ হওয়ায় ব্যাঙ্কগুলির মাথায় চেপেছে পাহাড় প্রমাণ অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা। ফলে অত্যন্ত খারাপ ত্রৈমাসিক ফলাফল প্রকাশ করেছে স্টেট ব্যাঙ্ক-সহ বেশির ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। পরিস্থিতি যা, তাতে বাজার এখন বেয়ার বলয়ের খুব গভীরে।
সামগ্রিক ভাবে বাজার এবং বিভিন্ন শেয়ার সম্পর্কে বিশ্লেষকরা এত দিন যে-সব আগাম অনুমান করেছিলেন তার প্রায় সবই ওলটপালট হয়ে গিয়েছে গত সপ্তাহের বড় ধসে। সময় হয়েছে নতুন করে অঙ্ক কষার। সর্বোচ্চ জায়গা থেকে এখনও পর্যন্ত সূচক নেমেছে ২৩.৫%। ২০১৬ বছরের প্রথম দেড় মাসে খুইয়েছে ১.১২%। গত দেড় বছরে যাঁরা শেয়ার অথবা ইক্যুইটি-নির্ভর মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করেছেন, তাঁরা অন্তর্বর্তী উত্থানে যদি বিক্রি করে না থাকেন, তবে বেশির ভাগ লগ্নিকারী বড় লোকসানের সামনে পড়েছেন। বাজার এতটা নেমে আসায় ইক্যুইটির প্রতি তো বটেই, ফান্ডের প্রতিও মানুষের আস্থা টলমল। ইক্যুইটি-বিরোধীরা ফের সরব হচ্ছেন শেয়ারের সঙ্গে লেপ্টে থাকা বড় মাপের ঝুঁকির বিরুদ্ধে।
এ বছরেই শুরু হয়েছে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ইক্যুইটিতে ঢালা। সময়টা আদৌ আদর্শ ছিল না। শুরুতেই বড় ধাক্কা খেয়েছে এই লগ্নি। যদিও এত ছোট সময়ে লাভ-ক্ষতির হিসেব করা ঠিক নয়। তবুও এই পরিস্থিতি মদত দেবে ইক্যুইটি-বিরোধীদের প্রতিবাদের ঝান্ডা নিয়ে পথে নামতে।
যদি এনপিএস (ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম)-এর দিকে তাকানো যায়, তা হলেও দেখা যাবে পরিস্থিতি সুখকর নয়। বিশেষ করে যাঁরা ইক্যুইটি লগ্নিতে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। গত এক বছরে টিয়ার ১-এর ৭টির সব ক’টি ইক্যুইটি প্ল্যানে লোকসান হয়েছে ১১.৭৩% থেকে ১৩.৬৬% পর্যন্ত। গভর্নমেন্ট বন্ড প্ল্যানে বৃদ্ধি হয়েছে ৩.২৫% থেকে ৪.০৪% পর্যন্ত। অন্য দিকে কর্পোরেট ডেট প্ল্যানে বৃদ্ধি হয়েছে ৭.৪৯% থেকে ৯% পর্যন্ত। একটু বড় মেয়াদের হিসেব নিলে অবশ্য দেখা যাবে ছবিটি অন্য রকম।
ভারতীয় অর্থনীতিতে অন্যতম বড় দুশ্চিন্তার কারণ হল, সরকারি ব্যাঙ্কগুলির পাহাড় প্রমাণ অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) বোঝা। ব্যাঙ্কিং শিল্পে এত খারাপ ত্রৈমাসিক ফলাফল বহু বছর দেখা যায়নি। দেশের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক, স্টেট ব্যাঙ্কের নিট লাভ ২,৫১৯ কোটি টাকা কমে ঠেকেছে মাত্র ১,৩৭৪ কোটিতে। পিএনবি ও দেনা ব্যাঙ্কের খারাপ ঋণ পৌঁছেছে মোট ঋণের যথাক্রমে ৮.৪% এবং ৯.৮ শতাংশে। শেষ তিন মাসে দেনা ব্যাঙ্কের লোকসান হয়েছে ৬৬৩ কোটি টাকা। নামমাত্র লাভ হয়েছে পিএনবি-র। কোনও কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ বাজারে তাদের শেয়ারের মোট মূল্যের থেকেও বেড়ে গিয়েছে। যেমন ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্কের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন যখন ৪,০৮০ কোটি, তখন এই ব্যাঙ্কের মোট এনপিএ ২২,৬৭২ কোটি টাকা। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের এনপিএ তাদের শেয়ারের মোট বাজার দরের প্রায় দ্বিগুণ। ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মোটামুটি এই রকম অবস্থা। বাংলার ইউকো ব্যাঙ্ক এবং এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের ত্রৈমাসিক লোকসান যথাক্রমে ১৪৯৭ কোটি এবং ৪৮৬ কোটি টাকা। তবে সবাইকে টেক্কা দিয়েছে ব্যাঙ্ক অব বরোদা। মাত্র তিন মাসে তাদের লোকসান ৩,৩৪২ কোটি। আইডিবিআই ব্যাঙ্কের লোকসান পৌঁছেছে ২,১৮৪ কোটিতে। ব্যাঙ্কিং শিল্পের এই পুরো ছবিটা বেশ আতঙ্কের। দেশে শিল্পের স্বাস্থ্য যে ভাল নয়, তার প্রতিফলন স্পষ্ট ।
খারাপ খবরের যেন শেষ নেই। ডাকঘর ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলির সুদকে বাজারে প্রচলিত সুদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে প্রতি তিন মাস অন্তর হেরফের করা হতে পারে সুদের হার। অর্থাৎ তা কমছে। প্রথম ধাক্কাটি আসবে ১ এপ্রিল থেকে। সুদের অবনমনের ব্যাপারে অবশ্য সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছে সুকন্যা সমৃদ্ধি এবং সিনিয়র সিটিজেন্স সেভিংস প্রকল্পকে। অর্থাৎ সুদ কমানো হতে পারে ডাকঘর মাসিক আয়, এনএসসি, টাইম ডিপোজিট, পিপিএফ ইত্যাদি প্রকল্পে। এর ফলে বড় রকম সমস্যায় পড়বেন সুদ নির্ভর মানুষেরা।
এ দিকে, ডলার পৌঁছেছে ৬৮.২৩ টাকায়। আশঙ্কা, ডলারে টাকার দাম আরও পড়তে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমদানি-নির্ভর শিল্প। খরচ বাড়বে বিদেশে পড়া এবং বেড়ানোর।
অবশ্য ভাল খবর যে একদম নেই তা নয়। কর্মচারী প্রভিডেন্ট ফান্ডে সুদ না-বাড়িয়ে এককালীন বোনাস দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে ইপিএফ-ও। প্রভিডেন্ট ফান্ডে গত বছর সুদ ছিল ৮.৭৫%। ফলে সুদ বাড়ালে বাজারের তুলনায় তা অনেকটাই বেশি হবে। এই কথা মাথায় রেখে ৭৫০ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তহবিল বোনাস হিসাবে দেওয়া যায় কি না, তা বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে।
অনিশ্চয়তার বাজারে সোনা ফের শিখরে। ২৪ ক্যারাট সোনা ৩০ হাজারের দোরগোড়ায়। ফলে দাম বেড়েছে গোল্ড ফান্ড এবং গোল্ড ইটিএফ-এর। সোনায় লগ্নিকারীরা বহু দিন বাদে ভাল দামের সন্ধান পেলেন। দাম বেড়েছে রুপোরও।
তবে শেয়ারে লগ্নি ঘিরে আশার কথা একটাই, পড়ন্ত বাজার সুযোগ সৃষ্টি করেছে কম দামে ভাল শেয়ার কেনার। ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে বড় লাভ করতে চাইলে একে কাজে লাগিয়ে— (১) অল্প করে প্রতি মাসে বাছাই করা ভাল শেয়ার কিনুন। (২) ফান্ডে এসআইপি চালান। (৩) প্রতিটি বড় পতনে ভাল শেয়ার এবং ভাল ফান্ড ইউনিট কিনুন। আশা, বড় মেয়াদে অবস্থা পাল্টাবে। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতিবারই বড় ধসের পর বাজার ফের অনেক বেশি শক্তি নিয়ে উঠেছে। তলিয়ে যাওয়া বাজারে ঠিক শেয়ার কিনলে বড় মেয়াদে তা ভাল বাড়ে। এখন নজর মোদীর মেক ইন ইন্ডিয়া ও জেটলির আগামী বাজেটের উপর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy