Advertisement
০৬ মে ২০২৪

উন্নত দুনিয়ার সঙ্গে টক্করের চাবিকাঠি বিশ্ব মানের দক্ষতা

পাইপে ফুটো। মেঝে জলময়। মার্কিন মুলুকের সস্তা হোটেলে এমন চূড়ান্ত বেকুব অবস্থায় কলের মিস্ত্রি ডেকেছিলেন সুব্রত বাগচি। মাঝে আড়াই দশক পার করেও সেই মিস্ত্রিকে ভুলতে পারেননি মাইন্ড ট্রি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার।

মাস্টারমশাই। মাইন্ড ট্রির শিক্ষানবীশ ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে সুব্রত বাগচি।

মাস্টারমশাই। মাইন্ড ট্রির শিক্ষানবীশ ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে সুব্রত বাগচি।

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:৪৯
Share: Save:

পাইপে ফুটো। মেঝে জলময়।

মার্কিন মুলুকের সস্তা হোটেলে এমন চূড়ান্ত বেকুব অবস্থায় কলের মিস্ত্রি ডেকেছিলেন সুব্রত বাগচি। মাঝে আড়াই দশক পার করেও সেই মিস্ত্রিকে ভুলতে পারেননি মাইন্ড ট্রি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার।

বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলছিলেন, ‘‘ওই মিস্ত্রির সঙ্গে যা যন্ত্র ছিল, তা দিয়ে সারাইয়ের ছোট দোকান খোলা যায় অনায়াসে। এসেই সে পাইপে হুমড়ি খেয়ে পড়েনি। বরং চোখা প্রশ্ন করেছিল। বুঝতে চেয়েছিল সমস্যার উৎস। জানতে চেয়েছিল, আমি কী চাই। আমার কাছে দক্ষতার মাপকাঠি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সে দিনই।’’

সুব্রতবাবুর মতে, এ দেশে ঘাটতি শুধু দক্ষ কর্মীর নয়। ফারাক দক্ষতার গুণমান, উৎকর্ষেও। পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে ওই ব্যবধান না ঘুচলে, ভারতের পক্ষে উন্নত অর্থনীতির দেশ হওয়া শক্ত বলেই মনে করেন তিনি।

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হোক বা নিরাপত্তা কর্মী— প্রায় সব পেশাতেই দক্ষ পেশাদারের অভাব ভারতে প্রবল। সুব্রতবাবুর কথায়, সমস্যার এই সমুদ্র পেরোতে সেতু তৈরির প্রথম ইঁট গাঁথার মতো করেই ভুবনেশ্বরে চন্দকা বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (মাইন্ড ট্রি-কলিঙ্গ) গড়েছেন তাঁরা। আনুষ্ঠানিক ভাবে যার উদ্বোধন হল মঙ্গলবারই।

২০ একরে ছড়িয়ে থাকা ক্যাম্পাস গড়তে লগ্নি প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। পরিকাঠামো আন্তর্জাতিক। কিন্তু মাইন্ড ট্রি কর্ণধারের মতে, এই পরিকাঠামো শুধু মূল আয়োজনের প্রথম সিঁড়ি। আসল লক্ষ্য, দীর্ঘ মেয়াদে উন্নত দুনিয়ার কর্মীর সঙ্গে এ দেশে প্রশিক্ষিত কর্মীর ফারাক মুছে ফেলা।

‘দ্য প্রফেশনাল’, ‘গো কিস দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর মতো জনপ্রিয় বইয়ের লেখকের মতে, শুধু কম্পিউটার কোডিং করলেই ইঞ্জিনিয়ারের কাজ শেষ নয়। প্রয়োজন, চিন্তা-ভাবনার অনায়াস আদান-প্রদানের জন্য ভাষার স্বাচ্ছন্দ্য, গ্রাহকের চাহিদা বুঝে প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা। জরুরি, বহু দূরের ছবি দেখতে পারার দক্ষতাও।

ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেল, সেখানকার ক্যান্টিনে যে খাবার রোজ নষ্ট হয়, তা কমাতে সফটওয়্যার তৈরির চেষ্টা করছেন কেউ। আবার কেউ দায়িত্ব পেয়েছেন অনুষ্ঠানে ভিড় সামলানোর। যাতে ভবিষ্যতে ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার তৈরি তাঁর কাছে সহজ হয়। ক্যাম্পাসের ঠিক মাঝে স্তূপ হয়ে আছে লাল কাদা মাটি। তার সঙ্গে সামান্য সিমেন্ট মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ইঁট। জানা গেল, পুরো ক্যাম্পাসই ওই ইঁটে গড়া। কেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অনিন্দ্য মৈত্র বলছিলেন, ‘‘এখানকার শিক্ষানবীশ ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে এটা একটা শিক্ষা। মনে করিয়ে দেওয়া যে, অন্যের নকল করে পণ্য তৈরির বদলে শূন্য থেকে শুরু করা কতটা সন্তুষ্টির।’’

সুব্রতবাবুর মতে, শুধু সস্তায় কর্মী জুগিয়ে ব্যবসার মডেল তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় বেশি দিন চলবে না। চাহিদা বাড়বে এমন ইঞ্জিনিয়ারের, যিনি ক্রেতার মাথায় সেঁধিয়ে যেতে পারদর্শী। আগাম পড়ে ফেলতে পারেন বাজারের চাহিদা। সফটওয়্যার তৈরিও করেন সেই অনুযায়ী। সব পেশায় চাহিদা আগাম বুঝে পণ্য জোগানোর এই ক্ষমতাই দক্ষতার মূল মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি।

সিআইআইয়ের পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা সৌগত মুখোপাধ্যায়ের মতেও, ‘‘দক্ষ কর্মী পাওয়া প্রায় হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, যিনি কলকাতার ট্যাক্সি ড্রাইভার, তিনি বিমানবন্দরে প্রথম বার পা রাখা বিদেশি পর্যটকের কাছে এই শহরের মুখও। ফলে তাঁর পোশাক, ব্যবহার, ভাষা এবং অতিথির প্রয়োজন বুঝে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষমতাও গাড়ি চালানোর দক্ষতার মতোই জরুরি। বিযয়টি মাথায় রেখে সিআইআই-ও নানা প্রশিক্ষণ দেয়।

প্রায় ১৫ হাজার কর্মীর সংস্থা মাইন্ড ট্রি-র নতুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সর্বত্র ওয়াই-ফাই। ১০টি ‘ক্লাসরুম’-এ বিশেষ চেয়ার। যাতে বসে কাজ করতে করতে চট করে জায়গা বদলাচ্ছেন শিক্ষানবীশরা। মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে ক্লাসের বিন্যাস। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারমশাইকে গোল করে ঘিরে পড়া শোনার ধাঁচ থেকে সরে গিয়ে তার চেহারা দাঁড়াচ্ছে এমআইটি-র মতো। যেখানে ক্লাস চলাকালীনই উদ্ভাবনী আলাপ-আলোচনার জন্য টেবিলে এক হয়ে যাচ্ছে চার ইঞ্জিনিয়ারের মাথা। তাঁদের থাকার জায়গাও তৈরি হয়েছে মার্কিন মুলুকের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ডর্ম রুমের আদলে। সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ‘আড্ডা’র জায়গা। আয়োজন, পারষ্পরিক ভাবনা আদান-প্রদানের চকমকিতে উদ্ভাবনের আগুন জ্বালানোর। তাঁর কথায়, ‘‘উন্নত দুনিয়ায় কলের মিস্ত্রি আসেন গাড়ি হাঁকিয়ে। সেখানে এ দেশে আজীবন স্যুট বানানো দর্জি অভাবের কারণে তা গায়েই দেননি কখনও। তা হলে হাত তুললে কোথায় টান পড়বে, তিনি তা বুঝবেন কী ভাবে?’’ অনিন্দ্যবাবুও বলছিলেন, ‘‘সংস্থায় ৪৮% কর্মীই আসেন মধ্য বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। সফটওয়্যার তৈরি নয়, পাঁচ তারার বাথরুম ব্যবহারই প্রথম দিকে তাঁদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়!’’ সুব্রতবাবুর দাবি, এই ফারাক মোছাই চ্যালেঞ্জ। লক্ষ্য, নিখুঁত কোট বানাতে আগে দর্জির গায়ে স্যুট চড়ানো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE