Advertisement
১৬ মে ২০২৪
আটকে ২,০০০ কোটি

বানতলায় নতুন লগ্নির পথে বাধা সেই দূষণই

বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের (এসইজেড বা সেজ) তকমা রয়েছে। ফাঁকা জমি রয়েছে। টাকা ঢালতে তৈরি বিনিয়োগকারীরাও। কিন্তু এই সব কিছু সত্ত্বেও নতুন কারখানা তৈরি করা যাচ্ছে না বানতলায়। কারণ, দূষণে লাগাম টানার পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাবে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রই দিতে পারছে না রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। ফলে আটকে রয়েছে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার লগ্নি। আর সেই সঙ্গে অন্তত দেড় লক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও।

গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের (এসইজেড বা সেজ) তকমা রয়েছে। ফাঁকা জমি রয়েছে। টাকা ঢালতে তৈরি বিনিয়োগকারীরাও। কিন্তু এই সব কিছু সত্ত্বেও নতুন কারখানা তৈরি করা যাচ্ছে না বানতলায়। কারণ, দূষণে লাগাম টানার পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাবে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রই দিতে পারছে না রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। ফলে আটকে রয়েছে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার লগ্নি। আর সেই সঙ্গে অন্তত দেড় লক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও।

বানতলা চর্মনগরী তৈরি করে বেসরকারি নির্মাণ সংস্থা এম এল ডালমিয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী, যাবতীয় পরিকাঠামো তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব তাদেরই। এর মধ্যে রাস্তাঘাট, নিকাশি, আলো, দমকল কেন্দ্র, পুলিশ ফাঁড়ি যেমন রয়েছে, তেমনই আছে বর্জ্য বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথাও। কিন্তু শুরু থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছে এই বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা। চর্ম ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই রকম ছ’টি ব্যবস্থা (কমন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা সিইটিপি) তৈরির বদলে করা হয়েছে মাত্র চারটি।

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র জানান, পর্যাপ্ত বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবেই নতুন প্রকল্পকে সবুজ সংকেত দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘‘ছ’টি সিইটিপি হওয়ার কথা ছিল। রয়েছে চারটি। প্রতিদিন ৫০ লক্ষ লিটার বর্জ্য পরিশোধন করার ক্ষমতা ধরে একটি সিইটিপি। ফলে এখন চারটিতে মোট ২ কোটি লিটার বর্জ্য পরিশোধন করা হয়। অথচ সেখানে বর্জ্যের পরিমাণ ৩ কোটি লিটার। সুতরাং ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।’’ এই পরিস্থিতিতে নতুন প্রকল্পের জন্য ছাড়পত্র দেওয়ার প্রশ্নই নেই বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তবে একই সঙ্গে তিনি জানান, পরিকাঠামোগত ত্রুটির কারণে এ ভাবে লগ্নি আটকে থাকা দুর্ভাগ্যজনক।

চর্ম ব্যবসায়ীদের দাবি, বানতলার ৩৫০টি কারখানা থেকে এখন রফতানি হয় ৫,০০০ কোটি টাকার পণ্য। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সেখানে কাজ করেন পাঁচ লক্ষ মানুষ। চর্ম নগরীর সাধারণ সম্পাদক এবং কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টসের সদস্য ইমরান আহমেদ খানের অভিযোগ, শুধু দূষণে রাশ টানতে না-পারার কারণে আটকে রয়েছে ২,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান।

১,১০০ একরের এই বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে ৫৬৫ একর জমি বিক্রি করা যাবে। তার মধ্যে চর্ম শিল্পের জন্য বরাদ্দ ২০২ একর জমি। চর্ম ব্যবসায়ীদের দাবি, সেখানে কারখানা গড়তে আরও ৫৯৫টি আবেদনপত্র জমা দেওয়া আছে রাজ্যের শিল্প দফতরে। আর ১২০ একর জমিতে তৈরি হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প তালুক। দূষণের সমস্যার কারণে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে সেই শিল্প তালুকের ভবিষ্যৎ নিয়েও।

সব মিলিয়ে বানতলার এই বেহাল দশায় প্রশ্ন তুলছে শিল্পমহল। তারা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, বানতলা সেজ-কে প্রথম থেকেই তাড়া করে ফিরেছে দূষণের ভূত। শুধু তা-ই নয়, দূষণ ঠেকাতে চর্মশিল্পের জন্য ওই তালুক গড়া হয়। অথচ তারপরেও সেখানে মূল সমস্যা হয়ে থেকে গিয়েছে সেই দূষণই। ১৯৯৫ সালে কলকাতাকে দূষণমুক্ত করতে ট্যাংরা, তপসিয়া এলাকার ৫৩৮টি চামড়া কারখানা বা ট্যানারিকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ওই সব কারখানা থেকে দৈনিক বর্জ্যের পরিমাণ ছিল তিন কোটি লিটার। তারই সমাধান সূত্র হিসেবে তৈরি হয় বানতলা চর্মনগরী। কিন্তু এত কাণ্ডের পরেও নতুন লগ্নির পথে সেই দূষণই বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় হতাশ তারা।

শিল্পমহলের অভিযোগ, ছোট ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ টানতে নতুন নীতি তৈরি করছে রাজ্য। অথচ বানতলায় যে শিল্পতালুক ছোট ও মাঝারি চর্ম ব্যবসায়ীদের জন্য তৈরি রয়েছে, তার জট ছাড়াতে প্রশাসনের উদ্যোগ নেই। শিল্প দফতর সূত্রে খবর, এ বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি। নির্মাণ সংস্থা এম এল ডালমিয়ার তরফ থেকেও এ নিয়ে মুখ খোলেননি কেউ।

প্রশাসনের এই হাল ছেড়ে দেওয়া মনোভাবে স্বাভাবিক ভাবেই হতাশ চর্ম ব্যবসায়ীরা। বিশেষত এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্মাণ সংস্থার গলদ জেনেও তাদের বিরুদ্ধে রাজ্য ব্যবস্থা না-নেওয়ায় তাঁরা ক্ষুব্ধ। রাজ্যের বৃহত্তম এই সেজ-এর বেহাল দশা ঘোচাতে বিশেষ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ বা টাউনশিপ অথরিটি তৈরির সিদ্ধান্তও অনেক আগে নিয়েছে রাজ্য মন্ত্রিসভা। কিন্তু এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে নতুন লগ্নির গন্তব্য হওয়ার বদলে এখনও সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে বানতলা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE