বেশ কিছু দিন ধরে দু’টো বিষয় নিয়ে চর্চা চলছিল কূটনীতিক মহলে। এক, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেন থাকবে কি না। দুই, প্রথম দফায় মেয়াদ শেষের পর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে রঘুরাম গোবিন্দ রাজনের প্রত্যাবর্তন ঘটবে কি না।
প্রথমটার জবাব পেতে হলে তাকিয়ে থাকতে হবে ২৩ জুনের গণভোটের দিকে। দ্বিতীয়টায় যবনিকা পড়ে গেল আজ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মীদের খোলা চিঠি দিয়ে রাজন জানিয়ে দিলেন, দ্বিতীয় দফায় গভর্নর পদের দায়িত্ব আর নিতে চান না তিনি। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ফিরে যাবেন শিক্ষকতা ও গবেষণার জগতে। চিঠিতে রাজন জানিয়েছেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত।
রাজনের চিঠির পর টুইটার ও ফেসবুকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি লেখেন, ‘রঘুরাম রাজন শিক্ষাজগতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকার তাঁর কাজকে সাধুবাদ এবং তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাচ্ছে। তাঁর উত্তরসূরির বিষয়ে খুব শীঘ্রই সিদ্ধান্ত হবে।’
বিদায়ের ইচ্ছের কথা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে আগেই জানিয়েছিলেন রাজন। গত ১ জুন আনন্দবাজারেই প্রথম সেই খবর প্রকাশিত হয়। এর ঠিক দু’দিন আগে রাজন বৈঠক করেন মোদীর সঙ্গে। তখনই প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, মেয়াদ ফুরোনোর পর আর গভর্নর পদে থাকতে চান না। বৈঠকের পাশাপাশি চিঠি দিয়েও তিনি মোদীকে এই কথা জানিয়েছিলেন।
ওই সময়ে রাজনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ চরমে তুলেছিলেন বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। প্রশ্ন ছিল, মোদী ও জেটলি কী সিদ্ধান্ত নেন। রাজনের অর্থনীতিকে মোদী যে অপছন্দ করেছিলেন, তা নয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কও মধুর ছিল। শেষ বৈঠকেও মোদী রাজনকে বারবার অনুরোধ করেন, তিনি যেন হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেন। রাজনকে তিনি চাইছেন না— এমন কথাও বলেননি। জেটলি অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর মূলত সুদের হার নিয়ে তাঁর সঙ্গে রাজনের কিছুটা বিরোধ বেধেছিল। জেটলির যুক্তি ছিল, বাজারের দিকে তাকিয়ে, শিল্পমহলের কথা ভেবে রাজনীতিকদের সুদের হার কমানোর কথা ভাবতেই হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যস্থতাতেই দু’জনের সম্পর্কটা পেশাদারিত্বের জায়গায় আসে। এর পর যখন জেটলির বিরোধী হিসেবে পরিচিত স্বামী রাজনকে সরানোর দাবি তোলেন, তখন দেখা যায়, গভর্নরের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
কেন? রাজনীতিকদের মতে, এর দু’টো কারণ। প্রথমত, স্বামী সরব হতেই শিল্পমহল থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদেরা রাজনের পাশে দাঁড়িয়ে যান। তাঁরা বলে দেন, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ও টাকার দাম স্থিতিশীল রাখতে যে নীতি রাজন নিয়েছেন, তার পর তিনি চলে গেলে ক্ষতি হবে। দ্বিতীয়ত, আনন্দবাজারে প্রকাশিত সংবাদটিকে ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তুলে ধরায় শেয়ার বাজারে ধাক্কা লেগেছিল। পতন হয়েছিল টাকার দামেও। ফলে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব ভাবছিলেন, রাজনকে রেখে দেওয়াটাই ঠিক হবে কি না।
কিন্তু সব থেকে বড় সমস্যা হল সঙ্ঘ পরিবার। অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খুলে সঙ্ঘকে আগেই চটিয়েছিলেন রাজন। আজও আরএসএসের নাগপুরের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘স্বামী জাতীয়তাবাদী। রাজনের সঙ্গে দেশের স্বার্থ যুক্ত নয়।’’ সঙ্ঘ ও সরকারের মধ্যস্থতাকারী কৃষ্ণগোপাল সম্প্রতি মোদীকে জানিয়ে এসেছিলেন, রাজনকে সরানোর ব্যাপারে নীতিগত অবস্থান নিচ্ছেন তাঁরা। এই কাজেই স্বামীকে যথাসম্ভব ব্যবহার করেছে সঙ্ঘ। স্বামীর রাজ্যসভায় মনোনয়ন আরএসএসের মাধ্যমেই হয়েছিল। আজ স্বামী টুইট করেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদীর প্রতি শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে গেল। চাপ সত্ত্বেও তিনি মাথা নত করেননি।’’
আরও একটা কারণ আছে। অন্দরের খবর, পরামর্শ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও অর্থ মন্ত্রকের আমলাদের থেকে খুব খারাপ প্রতিক্রিয়া পেতেন রাজন। বাজেটের আগে একটি পরামর্শদাতা কমিটি তৈরি করেছিলেন তিনি। সেটিকে খারিজ করে দেওয়া হয়। এর পরেও স্বামী যখন আক্রমণ শুরু করেন, রাজনের থাকা না-থাকা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি মোদী। নিপাট ভদ্রলোক রাজন সসম্মান বিদায়কেই বেছে নেন।
রাজনের উত্তরসূরি হিসেবে এসবিআইয়ের চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য-সহ সাত জনের নাম নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। এ ছাড়া গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যসচিব ডি রাজাগোপালনের নামও উঠে আসছে জল্পনায়। যদিও এন আর নারায়ণমূর্তি, আনন্দ মহীন্দ্রা, কিরণ মজুমদার শ, দীপক পারেখের মতো দেশের তাবড় শিল্পপতিরা একবাক্যে বলেছেন, রাজনের বিদায়ে তাঁরা ব্যথিত। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘‘বিশ্বের অন্যতম দক্ষ অর্থনৈতিক চিন্তাবিদকে আমরা খোয়ালাম।’’ খোঁচাটা অবশ্য দিয়েছেন রাহুল গাঁধী। টুইটারে লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সব জানেন। তাঁর রঘুরাম রাজনের মতো বিশেষজ্ঞের কোনও প্রয়োজন নেই!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy