প্রোফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে কত যে বিচিত্র রকমের আর্থিক পরিকল্পনার হদিস পাই, তার ইয়ত্তা নেই। বেতন চোখে দেখা যায় না, অথচ প্রথমেই অবসর জীবনের জন্য কোটি খানেক জমাবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কেউ। আবার কেউ হয়তো মাস গেলে মোটা টাকা ঘরে তোলেন, কিন্তু তাঁদের অগ্রাধিকার গাড়ি-বাড়ি কেনা, বেড়ানো। সঞ্চয়ের পথে হাঁটেন তার পরে। যে-কারণে ভুল প্রকল্পে টাকা ঢালার আশঙ্কা থাকে।
আমি সব মানুষের সমস্ত লক্ষ্য ও ইচ্ছেকেই সম্মান করি। সন্তানের পড়ার টাকা জোগাড় বা অবসর জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষার ব্যবস্থা করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই জরুরি গাড়ি, বাড়ির শখ মেটানো বা দেশ-বিদেশ দেখার ইচ্ছেপূরণ। তবে দু’টোর মধ্যে সামঞ্জস্য জরুরি। জীবনযাপনের খরচ সম্পদ তৈরির তুলনায় বেশি হলে, আয় যত বেশিই হোক, পায়ের তলার জমি আলগা হতে সময় লাগে না।
অনিলাভর চিঠি পড়ে যা যা মনে হয়েছে, সেগুলি দিয়েই লেখা শুরু করব। তার পরে চোখ রাখব ইচ্ছেগুলো কী ভাবে পূরণ করা যায়, তার উপর।
আগে কোনটা
অনিলাভর রোজগার মাসে ১ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা। যথেষ্ট বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় সম্পদ তৈরির চেষ্টা তাঁর মধ্যে কম চোখে পড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের রাস্তাও ঠিক মতো বাছা হয়নি। যদিও বয়স কম হওয়ায় তাঁর হাতে
সময় আছে। তবুও—
• অনিলাভর একার কাঁধে যেহেতু চার জনের দায়িত্ব, তাই অসময়ের জন্য যতটা সম্ভব বেশি জমানোর দিকেই আগে নজর দেওয়া উচিত তাঁর।
• তার উপর রয়েছে ব্যবসায় লগ্নি বাড়ানোর ঝুঁকি। নির্দিষ্ট সময় অন্তর মূলধন না-ঢাললে ব্যবসা চালানো মুশকিল। আর সেই ঝুঁকি বইতে নিয়মিত রোজগারের বেশ কিছুটা সঠিক পথে সঞ্চয়ের কথা ভাবতে হবে। যাতে প্রয়োজনে তা কাজে আসে।
একশোয় একশো
অনিলাভ স্বাস্থ্যবিমা করার ক্ষেত্রে পুরো নম্বর পেয়েছেন।
• তিনি পরিবারকে মূল বিমার আওতায় এনেছেন।
• পাশাপাশি আলাদা স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প কিনেছেন বাবা-মায়ের জন্য।
• টপ আপের মাধ্যমে দু’টিরই বিমা কভারেজ বাড়িয়েছেন।
অফিসে মেডিক্লেমের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাঁর এই পরিকল্পনা আমি আদর্শ উদাহরণ হিসেবেই রাখলাম।
কম খরচে সুরক্ষা
স্বাস্থ্যবিমা করার ক্ষেত্রে অনিলাভর বিচক্ষণতা কিন্তু জীবনবিমায় দেখতে পেলাম না। কারণ—
• তাঁর ৪টি জীবনবিমা প্রকল্প। সব মিলিয়ে প্রিমিয়াম মাসে ২৭,৭২১ টাকা। একটা এনডাওমেন্ট জীবনবিমা প্রকল্পেরই ঘোরতর বিরোধী আমি। তার উপর এতগুলো। সম্পদ তৈরির সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে এই কারণে।
তবে এখন শুধু ৫০ লক্ষ টাকার জীবনবিমা ও তার সঙ্গে বাড়তি ৫০ লক্ষ টাকা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর জন্য করানো বিমার প্রসঙ্গেই কথা বলব।
• এই দু’টি মিলিয়ে মাসে অনিলাভ ২৩,৭০০ টাকা প্রিমিয়াম দেন। অর্থাৎ বছরে ২,৮৪,৪০০ টাকা। অথচ ৩০ বছর বয়সে ৩০ বছরের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার টার্ম পলিসি করালে প্রিমিয়াম হতে পারে, ধূমপায়ীদের বছরে ৯,৭২৮ টাকা, না-হলে ৬,০৬৯ টাকা। আর সেই সঙ্গে আরও ৫০ লক্ষের ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা বিমার আওতায় ঢুকলে লাগে বছরে ৫,৮৬৫ টাকা। অতএব ভেবে দেখুন অকারণে কত টাকা নষ্ট হচ্ছে অনিলাভর।
• দু’টো যোগ করে গড় খরচ খুব বেশি হলে বছরে ১৫ হাজার। মানে, বাঁচছে ২,৬৯,৪০০ (২,৮৪,৪০০-১৫,০০০) টাকা। কোনও ব্যালান্সড ফান্ডে ২৫ বছর মেয়াদে এই টাকা রাখলে ১০% সুদে তৈরি হতে পারে প্রায় ৩ কোটির তহবিল। এনডাওমেন্ট পলিসির রিটার্নের চেয়ে অনেক বেশি।
• আমি বলব, সমস্ত জীবনবিমা প্রকল্প পর্যালোচনা করুন। তার পরে সেই অনুযায়ী বদল আনুন। পেশাদার কারও সাহায্যও নিতে পারেন।
• মনে রাখবেন, জীবনবিমা প্রকল্প পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে করা হয়। সঞ্চয় হিসেবে এর রিটার্ন সবচেয়ে ভাল কখনওই হয় না। তাই বুদ্ধিমান গ্রাহকরা শুধু বিমামূল্য দেখেই প্রকল্প বাছেন, রিটার্ন দেখে নয়। আর সে ক্ষেত্রে টার্ম পলিসি অনেক সস্তার।
ভাল-মন্দের ফান্ড
অনিলাভর মিউচুয়াল ফান্ডের লগ্নিতে দেখছি ভাল-মন্দের মিশেল। যেমন—
• অবসরের তহবিল তৈরির লক্ষ্যে কেনা ফান্ড। আমার মতে এ রকম ‘লেবেল’ আঁটা পণ্য কেনার মানে হয় না। বরং ঢের ভাল বিভিন্ন ধরনের লগ্নি প্রকল্পে টাকা ছড়িয়ে দিয়ে আলাদা আলাদা তহবিল গড়ে তোলা। যেমন শেয়ার বাজার, পিপিএফ, ফিক্সড ডিপোজিট, ইকুইটি বা ডেট ফান্ড ইত্যাদি। অল্প করে ছড়ানো টাকাই লম্বা মেয়াদে বেড়ে উঠবে। অবসর জীবনে সেই তহবিল থেকে হবে মাসিক আয়ের ব্যবস্থা। সঞ্চয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় এতে ঝুঁকি কম থাকে। লোকসানের ইঙ্গিত পেলে অনেক কম খরচে লগ্নির জায়গাও বদলানো যায়। অনিলাভ যে অবসরের ফান্ড কিনেছেন, ৬০ বছরের আগে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে কিন্তু বাড়তি খরচ দিতে হবে।
• অবসরকালীন তহবিল তৈরির ফান্ডের পরিবর্তে তিনি পারলে ইকুইটি ফান্ড কিনুন। লম্বা মেয়াদে রিটার্ন অনেক বেশি পাওয়ার সুযোগ থাকবে।
• লিকুইড ফান্ডের টাকা বেড়াতে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
• অন্য ইকুইটি ফান্ডটি লগ্নি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভাল।
অবসরের তহবিল
অবসর সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা অনিলাভর পরিকল্পনায় খুব জোরালো নয়। হয়তো বয়সটা এখনও কম বলেই। তবে আমি বলব—
• ভিপিএফে অর্থ বরাদ্দ করুন।
• নিয়মিত টাকা রাখুন পিপিএফে।
• ইকুইটি ফান্ডে এসআইপি বাড়ান। শেয়ার বাজার ওঠা-পড়ার ঝুঁকি নেওয়ার আদর্শ বয়স এটাই।
• নগদের জোগান বজায় রাখতে সময়ে সময়ে কিছু টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করুন।
বেড়ানোর জন্য জমানো
অন্য সমস্ত ব্যাপারের মতোই একটা তুখোড় আর্থিক পরিকল্পনা দরকার বেড়াতে যাওয়ার জন্য। যেমন—
• দেশে হোক বা বিদেশে, প্রতিটি ভ্রমণের পরিকল্পনা সেরে ফেলতে হবে বেশ কিছু দিন আগেই। যাতে টাকার বন্দোবস্ত করার সময় পাওয়া যায়।
• এ জন্য শুরুতেই স্থির করতে হবে আর্থিক বরাদ্দ। যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, ঘোরা— সব কিছু আগাম পরিকল্পনা করে হিসেব করা জরুরি।
• বরাদ্দ অনুযায়ী টাকা জমাতে কাজে লাগাতে হবে পরিকল্পনা ও বেড়াতে যাওয়ার মধ্যে পড়ে থাকা সময়টুকু। এই টাকা শেয়ার বাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় লগ্নি করা উচিত নয়। কারণ, স্বল্প মেয়াদে এখানে লোকসানের ঝুঁকি থাকে। অতএব, ভরসা রাখুন রেকারিং ডিপোজিট কিংবা ডেট ফান্ডের (শুধু ঋণপত্রে খাটে যে ফান্ডের তহবিল) উপর।
ব্যবসার পুঁজি
প্রত্যেক মাসে কিছুটা টাকা বাড়তি থাকে। তার একটা অংশ ব্যবসায় লাগানো যেতে পারে। তবে আমি অনিলাভর ব্যবসার মডেল সম্পর্কে কিছু জানি না। এটাও জানি না যে, মুনাফা বাড়ানোর জন্য কত দিন পর পর ব্যবসায় মূলধন ঢালা উচিত।
চার চাকা
অনিলাভ দামি গাড়ি কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তবে দামি বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন জানি না। কারণ, কারও কাছে ৬ লক্ষ টাকা দামের মারুতি সুইফট-ই বেশ দামি। আবার কেউ ১ কোটি টাকা গুনে পোর্শে ঘরে আনবেন। অনিলাভ যদি ১০ লক্ষ টাকা খরচ করে গাড়ি কিনতে চান, তা হলে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে হবে। কারণ, আয় বেশি হলেও এই মুহূর্তে বাড়তি অর্থ তাঁর হাতে থাকছে না।
আমার পরামর্শ, আগামী কয়েক বছর ধরে প্রত্যেক মাসে কিছুটা করে জমান। এর জন্য সম্ভব হলে ব্যক্তিগত খরচ কিছুটা ছাঁটতে হবে। জীবনবিমায় মাত্রারিক্ত প্রিমিয়াম কমানো যেতে পারে। বছরে বছরে বেতন বাড়লেও হাতে কিছুটা বাড়তি টাকা আসবে। এ ভাবে যখন বড় মাপের ডাউনপেমেন্ট করার ক্ষমতা তৈরি হবে, তখন গাড়ি কেনার পথে এগোতে পারেন।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy