Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রাস্তা চিনুন চক্রব্যূহ ভেদের

ঠিক যেন অভিমন্যুর দশা। আজ শেয়ার বাজার উথালপাথাল তো কাল সুদের হাঁড়িতে ভাত বাড়ন্ত। দু’দণ্ড স্বস্তির শ্বাস ফেলার জো নেই সঞ্চয়ের ময়দানে। চার দিকে ঘিরে ধরা অনিশ্চয়তার হাত থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজলেন শৈবাল বিশ্বাসঠিক যেন অভিমন্যুর দশা। আজ শেয়ার বাজার উথালপাথাল তো কাল সুদের হাঁড়িতে ভাত বাড়ন্ত। দু’দণ্ড স্বস্তির শ্বাস ফেলার জো নেই সঞ্চয়ের ময়দানে।

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৮ ০৬:৩০
Share: Save:

রকেট গতিতে দিব্যি একের পর এক মাইলফলক ভাঙছিল শেয়ার সূচক। চোখের নিমেষে হাজার পয়েন্ট পাড়ি দিচ্ছিল সেনসেক্স। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে তার অবস্থা টালমাটাল। কখনও আমেরিকার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধের তাল ঠোকাঠুকি, কখনও শুল্ক-যুদ্ধের দামামা তো কখনও আবার ব্যাঙ্কে ধার বাকি রেখে নীরব মোদীর চম্পট— নানা কারণে পেণ্ডুলামের মতো দুলেছে বাজার।

এই ঝুঁকি থেকে নিরাপদ দূরত্বে সুদের নিরাপত্তায় যে একটু নিশ্চিন্তে টাকা রাখবেন, তারও উপায় নেই। কারণ, আজ অনেক দিন ধরেই ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ নিম্নমুখী। মাঝে কিছু ব্যাঙ্ক আমানতে সুদ কিছুটা বাড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেই সুখও কপালে কত দিন সইবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন কেউই।

মিউচুয়াল ফান্ডও তো আর ভিন্‌ গ্রহের সঞ্চয় মাধ্যম নয়। ইকুইটি ফান্ড হলে তার রিটার্ন নির্ভর করবে বাজারের ওঠা-পড়ার উপর। আবার ডেট ফান্ড হলে সুদের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকবে। কারণ, বন্ড বা ঋণপত্রের দামের ওঠা-নামা তো সুদের উপরেই নির্ভর করে। তাই ফান্ডে টাকা রেখেও নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না।

প্রশ্ন হল, এই পরিস্থিতিতে কী করবেন? আসুন, একসঙ্গে উত্তর খুঁজি।

এটাই স্বাভাবিক

প্রথমেই বলি, সঞ্চয়ের চৌহদ্দিতেও অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। আগামী দিনে সেই কাঁটা উল্টো দিকে ঘোরার আশাও তেমন নেই। তাই প্রথম পরামর্শ, এই অনিশ্চয়তাকেই স্বাভাবিক বলে জানুন। সারা বিশ্বে এমন অনেক ঘটনা রোজ ঘটবে, যার সঙ্গে আপনার কোনও যোগ নেই। কিন্তু তার জের থাবা বসাবে আপনার হাতে থাকা শেয়ারের দাম, ফান্ডের ন্যাভে। কখনও তাতে আপনার লাভ হবে, অনেক সময় হবে ক্ষতিও। এমনটা ঘটতে থাকবে ধরে নিয়েই কিন্তু লগ্নির ঘুঁটি সাজাতে হবে। সেই মতো ছড়াতে হবে লগ্নি। ভারসাম্য রাখতে হবে রিটার্ন আর ঝুঁকি ছাঁটাইয়ের মধ্যে।

প্রথমে জরুরি

• ঠাণ্ডা মাথা: বাজারে ওঠা-নামা থাকবেই। সেই অনুযায়ী উঠবে-নামবে ফান্ডের ন্যাভও। একই ভাবে, রাতারাতি সুদ কমানোর কথা জানিয়ে দিতে পারে ব্যাঙ্কও। কিন্তু যা-ই ঘটুক, দুম করে তা শুনে ঝোঁকের মাথায় কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে বসবেন না।

• ধৈর্য ধরুন: কোনও শেয়ারের দাম হঠাৎ পড়লেই, সঙ্গে সঙ্গে তা বেচে দেওয়া কাজের কথা নয়। একই কথা প্রযোজ্য ফান্ডে। কিন্তু কোনও শেয়ার বা প্রকল্প লাগাতার ডোবালে, অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাকে ধরে রাখাও ঠিক নয়। কিন্তু তা বলে রাতারাতি কারও সম্পর্কে মূল্যায়ন বদলে ফেলাও অনেক ক্ষেত্রে বোকামি।

• লক্ষ্যে স্থির: সঞ্চয়ের জন্য যে কোনও প্রকল্পে টাকা রাখার আগে ভাবুন, সেখানে কেন তা রাখছেন আপনি। তাহলে পরে অনিশ্চয়তার সময়ে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। মনে করুন, একটি ইকুইটি ফান্ডে মাসিক কিস্তিুতে টাকা রাখছেন (এসআইপি)। তার ন্যাভও বাড়ছে বেশ ভালই। ভেবে রেখেছেন যে, লম্বা মেয়াদে (১৫-২০ বছর) সেখানে টাকা রেখে তা ব্যবহার করবেন সন্তানের উচ্চশিক্ষায়। হঠাৎ কিছু দিন কোনও কারণে শেয়ার বাজার ধাক্কা খাওয়ায় তার ন্যাভ হয়তো ধাক্কা খেল। সন্তানের উচ্চশিক্ষা যদি তখনও বছর দশেক দূরে থাকে, তবে রাতারাতি সেই ফান্ডের টাকা তুলে নেওয়া কাজের কথা কি?

• দেখুন সামগ্রিক ছবি: শুরুতেই বলেছি, অনিশ্চয়তা থাকবেই। তাই সেই অনুযায়ী ঘুঁটি সাজান। এমন ভাবে লগ্নি ছড়ান, যাতে রিটার্ন ও ঝুঁকি ছাঁটাইয়ের মধ্যে ভারসাম্য থাকে। নিশ্চিত করতে হবে, একটি ক্ষেত্র কোনও কারণে মুখ থুবড়ে পড়লে, অন্য কোনও প্রকল্প যেন তা সামাল দিতে পারে। ধরুন, বাজার পড়ছে, সাধারণত তা সামাল দিতে পারে সোনা। ইকুইটি ফান্ডের দুর্দিনে পিপিএফের সুদ অমূল্য হতে পারে । সঙ্গের পাই চার্টের দিকে তাকালে বিষয়টি একটু খোলসা হতে পারে।

তা ছাড়া, হয়তো দেখলেন, বাজার পড়ছে বলে ইকুইটি ফান্ড শেয়ার কম রিটার্ন দিচ্ছে। কিন্তু ডেট ফান্ডে ভাল মুনাফা হচ্ছে। তাই সব মিলিয়ে পোর্টফোলিও ভাল জায়গায় রয়েছে। তখন নিজেই কিছুটা শান্তি পাবেন।

• অল্প করে: চড়া বা মন্দা কোনও বাজারেই এক লপ্তে বেশি টাকা শেয়ার বা ফান্ডে নতুন করে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই ফান্ডে এসআইপি করতে পারেন। এতে প্রতি মাসে টাকা দিতে পারবেন। গায়ে কম লাগবে বাজারের ওঠাপড়া।

শেয়ারে লগ্নি করতে চাইলেও এক লপ্তে করবেন না। এ কথা বিশেষ করে প্রযোজ্য নতুন লগ্নিকারীদের জন্য। যদি ভাবেন ৩০,০০০ টাকা ঢালবেন, তা হলে প্রথমে কিনুন ৫,০০০ টাকার। কয়েক দিন দেখুন তা আরও পড়ে কি না। দাম কোন পথে হাঁটছে দেখে আবার টাকা ঢালুন।

* লগ্নির ক্ষেত্রে কেউ সাবধানী, কেউ ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন। এখানে আমরা সাধারণত বয়স অনুসারে কোথায় কত লগ্নি করা উচিত, তার একটা হিসেব দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যা দেখে বোঝা যাবে, মোটামুটি কী ভাবে তহবিল ছড়ালে ভাল হয়। বাকিটা অবশ্যই নির্ভর করবে আপনার আর্থিক অবস্থা, মানসিকতা, সংসারের দায়দায়িত্ব ও বয়সের উপরে।

শেয়ার বাজার

ধরুন, দেশে-বিদেশে ঘটা কোনও ঘটনার জেরে হুড়মুড়িয়ে পড়ছে শেয়ার বাজার। আপনার হাতে থাকা শেয়ারের দর চোখের সামনে কমছে। এমন তো হতেই পারে। শুরু থেকে তাই কয়েকটা কথা মাথায় রাখুন—

• সংস্থার আর্থিক অবস্থা, ঋণ, ইতিহাস ইত্যাদি দেখে তবে তার শেয়ারে লগ্নি করুন।

• পড়তি বাজারে লক্ষ্য থাকুক কম দামে ভাল ব্লু-চিপ সংস্থার শেয়ারে।

• বয়স কম হলে ও ঝুঁকি নিতে রাজি থাকলে, টাকা ঢালুন ভাল মিড ক্যাপ ও স্মল ক্যাপ সংস্থায়। যাতে আগামী দিনে তা থেকে মোটা মুনাফা ঘরে তোলার সুযোগ থাকে।

• বিভিন্ন ক্ষেত্র মিলিয়ে শেয়ার কিনুন। কে বলতে পারে ব্যাঙ্কের শেয়ার দরে ক্ষতি ওষুধ সংস্থা সামলে দেবে না?

• ঝুঁকি কমাতে মাঝে মাঝে শেয়ার বেচে লাভের টাকা তুলুন।

• নিয়মিত শেয়ারের ওঠা-পড়ায় নজর রাখুন।

মনে রাখবেন, গোড়ায় যত খুঁটিয়ে দেখে কোনও শেয়ার কিনবেন এবং পরে তার গতিবিধির বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকবেন, তত তার উপর বিশ্বাস থাকবে আপনার। তাই হঠাৎ পতনে দুম করে তা বেচে দেওয়ার চিন্তা মাথায় আসবে না। তা ছাড়া—

• যদি দেখেন হাতে থাকা কোনও সংস্থার শেয়ার বিপুল পড়ে গিয়েছে এবং তার দাম আর ওঠার তেমন সম্ভাবনা সে ভাবে নেই, তবে তখনই সেই শেয়ার বেচে বেরিয়ে আসুন।

• যদি শুধু বাজার পড়ছে বলে আপনার শেয়ারের দর কমে, (সংস্থার আর্থিক বা অন্য কোনও সমস্যা না থাকে) তা হলে বড় পতনে সেই ভাল শেয়ার অল্প করে কিনে রাখা ভাল।

• কম দামে পাওয়া যাচ্ছে মানেই যে তা ভাল শেয়ার, তা কিন্তু নয়। বহু সংস্থাই এখন ঋণের ভারে ধুঁকছে। আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। পরিচালন ব্যবস্থার গণ্ডগোল থাকতে পারে। তাই তার মান অবশ্যই দেখুন।

ইকুইটি ফান্ড

এই ক্ষেত্রেও আমার পরামর্শ, শুরু থেকেই শেয়ারের মতো এতে সজাগ ও সতর্ক থাকুন। তার জন্য—

• বয়স ও ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা অনুসারে লার্জ, মিড এবং স্মল ক্যাপ ফান্ডে ছড়িয়ে লগ্নি করুন।

• অন্তত প্রতি ছ’মাস অন্তর তহবিলের অবস্থা খতিয়ে দেখুন।

• লক্ষ্যের কথা ভেবে লগ্নি করুন।

• অবস্থা দেখে ইকুইটি ও ডেট ফান্ডের একটি থেকে অন্যটিতে টাকা সরানোর ব্যবস্থা করুন। সেই পথ শুরু থেকে খোলা রাখুন।

• বাজার পড়লেই এসআইপি বন্ধ করবেন না। কারণ তখনই কিন্তু লগ্নির সেরা সময়।

• মনে রাখবেন, বাজার পড়লে তবেই ফান্ড বেশি ইউনিট কিনতে পারে। আবার উঠলে, তখন দাম বাড়ে সেই ইউনিটের। তাই দীর্ঘ মেয়াদে বাজার ওঠা-পড়ার মধ্যে দিয়ে গেলে তবেই লাভবান হবেন আপনি।

ডেট ফান্ড

ঋণপত্রে লগ্নি কিন্তু বাজারের ভরাডুবির সময়ে ত্রাতা হতে পারে আপনার। তাই—

• দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্যের কথা ভেবে লগ্নি চালিয়ে যান।

• খুব জরুরি না হলে পড়তি বাজারে স্থায়ী আমানত থেকে ফান্ড বা ফান্ড থেকে আমানতে লগ্নি সরাবেন না।

• কর্পোরেট ডেট ফান্ডের ক্ষেত্রে রেটিং দেখুন। যাতে ঝুঁকি বোঝা যায়।

• বাজার বাড়ছে দেখেই শেয়ারে তহবিল সরাবেন না। নিজের ক্ষমতা ও বয়স অনুসারে সিদ্ধান্ত নিন।

আর সুদে টাকা?

গত এক বছরে ব্যাঙ্ক, ডাকঘরে সুদ কমেছে অনেকটা। মনে রাখবেন—

আকর্ষণীয় পিপিএফ: সুদ কমেছে ঠিকই, কিন্তু লগ্নি এবং ফেরত টাকার পুরোটাই করমুক্ত হওয়ায় পিপিএফে টাকা রেখে মোটা মুনাফার মুখ দেখা সম্ভব। তাই যাঁরা চাকরি করেন এবং সুরক্ষিত প্রকল্পে টাকা রাখেন, তাঁদের জন্য এটি এখনও আকর্ষণীয়।

ব্যাঙ্কে নজর: সম্প্রতি কিছু ব্যাঙ্ক আমানতে সুদ বাড়িয়েছে। আগামী দিনে অন্যান্য ব্যাঙ্কও সেই পথে হাঁটতে পারে। খেয়াল রাখুন আপনার ব্যাঙ্ক তার মধ্যে পড়ছে কি না। হাতে এক লপ্তে টাকা এলে এখানে বেশি সুদে রাখতে পারবেন।

ডেট ফান্ডে লগ্নি: এখানেও ভেবেচিন্তে পা বাড়াতে হবে। বন্ড বা ঋণপত্রের মেয়াদ যত বেশি হবে, ঝুঁকিও তত বেশি। এ জন্য এখন স্বল্প মেয়াদি ডেট ফান্ডে লগ্নি করলে ভাল।

শেষ পাত

অনিশ্চয়তা নিয়ে আর তিনটি কথা না বললে, বিষয়টি অসম্পূর্ণ থাকে—

• আচমকা কোনও দুর্ঘটনায় পরিবার যাতে বিপদে না পড়ে, তাই মোটা অঙ্কের টার্ম পলিসি করে রাখুন।

• কষ্টে জমানো টাকা যাতে হাসপাতালের বিল মেটাতেই চলে না যায়, তার জন্য স্বাস্থ্য বিমা জরুরি। নিয়মিত তার কভারেজ বাড়ান।ে

• এখন অনেক চাকরিই অনিশ্চিত। তাই প্রথম দিন থেকে সঞ্চয় শুরু করুন। পরে করব বলে ফেলে রাখবেন না।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ

(মতামত ব্যক্তিগত)

পরামর্শের জন্য লিখুন:

‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।

ই-মেল: bishoy@abp.in

ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Equity fund Mutual Fund Investment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE