আমাদের জীবন সোনা দিয়ে গড়া। বহু সন্তান। তাই বড়দা, মেজদা, সেজদা, নদা, গড়িয়ে সোনাদা। নতুন সন্তান, মুখ দেখতে অল্প হলেও সোনা দিতে হবে। ভাইঝির বিয়ে সোনা তো দিতেই হবে। মুখে ভাত, সোনা না দিলে সোনা ছেলের অকল্যাণ হবে যে!
এ না হয় দেওয়ার গল্প। রাখার অঙ্কও আমাদের সমাজে সোনা দিয়ে গড়া। টাকা বাড়িতে রাখলে পোকায় খাবে, না হলে চোরে নেবে। ব্যাঙ্কে রাখতেই পারি, কিন্তু ব্যাঙ্ক ডুবলে সব যাবে। ফিক্সড ডিপোজিট ভাল কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছুটা সোনা কিনে রাখা অবশ্য কর্তব্য।
কিন্তু এই চাপ সরকার আর নিতে পারছে না। আর তাই কেন্দ্রীয় সরকারে এই সোনা জমা প্রকল্প। আর বাজারের ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গিয়েছে প্রশ্নের ঝড়। এই প্রকল্প টিকবে তো? কেনই বা সরকার বাড়ির সোনায় হাত দিতে চাইছে? ইত্যাদি, প্রভৃতি।
আমরা সোনা কিনব তাতে সরকারের কী? এটাই আসল প্রশ্ন। তার সঙ্গে রয়েছে হাল্কা করে আর একটা প্রশ্ন। টিকবে তো?
এর উত্তর দেখতে গেলে আমাদের কিছু তথ্য দেখে নিতে হবে। আমাদের সোনা ছেলের মুখ দেখতে আমাদের যেমন পকেট হাল্কা হয়, সরকারেরও তেমন আমাদের আবদার মেটাতে চাপ নিতে হয় প্রচুর।
একটা ছোট অঙ্ক দেখে নেওয়া যাক। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী গত ১০ বছর ধরে আমরা বছরে ৯০০ থেকে ১০০০ টন সোনা আমদানি করি। তাতেও কুলায় না। কারণ সোনার চাহিদা বছরে প্রায় ৩০০ টন। ভারতের খনি থেকে বছরে মাত্র ২ টন সোনা তৈরি হয়।
মাঝের ফারাক মেটে কী ভাবে? বাকি চাহিদা মেটে পুরনো সোনা গলিয়ে। কেউ যখন সোনা কেনে তখন আবার কেউ অর্থের প্রয়োজন মেটাতা ঘরের সোনা বিক্রিও করে। কিন্তু তাতেও চাহিদা আর জোগানের মধ্যে একটা ফারাক থেকেই চায়।
বাংলায় বলি চলতি খাত। এটা হলে সেই খাতে বাণিজ্য যাকে সহজ করে বললে বলতে হয়, "কিনলাম আর খেলাম"। হিসাবের খাতায় সোনাও সেই গোত্রের। আর চলতি খাতের বিদেশি বাণিজ্যের আমদানির মধ্যে একটা বড় জায়গা ধরে রেখেছে সোনা। এই খাতে আমাদের আমদানি এমনিতেই বেশি, তার উপর সোনার ঘা।
সোনা আমদানি কমাতে বিভিন্ন সরকার নানান ব্যবস্থা নিয়েছে। বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে আমদানি থেকে একগাদা কর বসানো, সব কিছুই। এমনকী ৮০:২০ রুল পর্যন্ত। যে নিয়মে যে সোনা আমদানি করা হব তার ২০ শতাংশ বাধ্যতামূলক ভাবে রফতানি করতে হব গয়না বানিয়ে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। তাই এই নতুন প্রকল্প।
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল সোনা ধাতুর চাহিদা কমানো, বাজারে সোনার জোগান বাড়ানো আর সোনার আমদানি কমানো। সরকারের যুক্তি হল এতদিন সোনার চাহিদা কমাতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা ভারতীয়দের এই ধাতু নিয়ে যে প্রথাগত অনুভূতি তাকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। এই ব্যবস্থায় সাপ মারা আর লাঠি না ভাঙার যুক্তি নাকি কাজ করছে। কী ভাবে?
আপনার কাছে সোনা আছে। তা চোরের হাত বাঁচিয়ে রাখার খরচ আছে। সোনা খুব একটা ভাতে অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে দামে বাড়ে না। তবুও মানুষের সোনা চাই। তাই সরকার বলছে তোমার গয়না নিয়ে এস। আমি গলিয়ে নিয়ে তা আবার বাজারে বিক্রি করব। এতে সিন্দুকে বন্দী সোনা হাত ঘুরবে। বাজারে জোগান বাড়বে। আমদানির উপর চাপ কমবে। অর্থনীতির উপকার হবে।
আপনি কী পাচ্ছেন। কেন? সোনা! কিন্তু কাগজে। যতটা সোনা আপনি বিক্রি করছেন তার বিনিময়ে আপনি একটা বন্ড পাচ্ছেন যার দাম সোনার বাজার দামের সমান। তার সঙ্গে পাচ্ছেন সুদ।
(বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন........)
আর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এখানেই। সমালোচকরা বলছেন এই প্রকল্প বাজারে চলবে না। কারণ,
ক) সুদের হার যা তাতে আয়কর দিয়ে হাতে কিছু থাকবে না
খ) সারা বছরে ৩০ থেকে ৫০০ গ্রামের বেশি সোনা বন্ডে পরিবর্তন করা যাবে না।
গ) আশঙ্কা ৫০০ গ্রাম গলালে পিছনে কর পুলিশ ধাওয়া করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন সবথেকে বড় বাধা হতে পারে তৃতীয় আশঙ্কাটি। যদিও সরকার তার নির্দেশিকায় পরষ্কার বলেছে যে এই সব ক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্য, স্থানীয় লোকাচার এই সব দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাস্তবে সাধারণ মানুষকে এটা বোঝানো খুবই কঠিন হবে।
তাহলে কি প্রকল্পটি শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ল? বলা মুশকিল। সোনা গলিয়ে না কিনলেও, সোনার দোকানে কিস্তিতে অনেকে টাকা জমা দেন। ভবিষ্যতে তা সোনায় পরিবর্তন করে নেওয়ার জন্য। এই চাহিদাটা বন্ডে আসতে পারে। সেটাও খুব কম নয়। তবে সরকারে সেটা বাজার করতে হবে সেই ভাবেই। জন ধন প্রকল্পের মতোই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy