Advertisement
০৮ মে ২০২৪

‘একেবারে খতম করে দিয়েছি’, পঁচাত্তরকে মেরে কবুল সাতাশির

হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন এক বৃদ্ধ। পরনে তোয়ালে। পরিচিত এক জনকে দেখতে পেয়েই বললেন, “একেবারে খতম করে দিয়েছি। আমার উপরে অত্যাচার!” উপরতলায় উঠে নীচের বাসিন্দারা দেখলেন, ঘরের মেঝেতে এক বৃদ্ধ পড়ে রয়েছেন। শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ডান হাতে তখনও খাবার লেগে।

সরানো হচ্ছে সুমন ঘোষের মৃতদেহ। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী

সরানো হচ্ছে সুমন ঘোষের মৃতদেহ। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৩৫
Share: Save:

হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন এক বৃদ্ধ। পরনে তোয়ালে। পরিচিত এক জনকে দেখতে পেয়েই বললেন, “একেবারে খতম করে দিয়েছি। আমার উপরে অত্যাচার!” উপরতলায় উঠে নীচের বাসিন্দারা দেখলেন, ঘরের মেঝেতে এক বৃদ্ধ পড়ে রয়েছেন। শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ডান হাতে তখনও খাবার লেগে।

শঙ্কর-কাণ্ডের জের না মিটতেই রবিবার ফের খুনের এই ঘটনাটি ঘটেছে টালিগঞ্জ থানা এলাকার লেক মার্কেট সংলগ্ন যতীন দাস রোডে। নিহত সুমন ঘোষের বয়স ৭৫ বছর। অভিযুক্ত রণেন্দ্র রায়ের বয়স ৮৭! কী ভাবে এত বয়স্ক এক ব্যক্তি আর এক বৃদ্ধকে একাধিক ছুরির কোপ মেরে খুন করলেন, তাতে বিস্মিত দুঁদে পুলিশ অফিসারেরাও।

পুলিশ জানায়, রণেন্দ্রবাবু কেন্দ্রীয় পূর্ত দফতরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। তিনি টালিগঞ্জের যতীন দাস রোডে দূর সম্পর্কের ভ্রাতৃবধূ মধুশ্রী নাগের তিনতলা বাড়িতে থাকেন। ওই বাড়ির একতলায় ভাড়াটেও রয়েছে। নিহত সুমনবাবু মধুশ্রীদেবীর দূর সম্পর্কের ভাই। বেশির ভাগ সময় তিনি বাইপাস সংলগ্ন কালিকাপুরে একটি ফ্ল্যাটেই থাকতেন। দুপুরে প্রায়ই তিনি মধুশ্রীদেবীর বাড়িতে খেতে আসতেন। রণেন্দ্রবাবু মধুশ্রীদেবীর সংসারে তাঁর খাওয়া-খরচ হিসেবে টাকা দিতেন। কিন্তু সুমনবাবু কেন পয়সা দেন না, তা নিয়ে রাগ ছিল তাঁর। মধুশ্রীদেবী পুলিশকে জানিয়েছেন, এ দিন দুপুরে রণেন্দ্রবাবুর ছুরি হাতে রণং দেহি মূর্তি দেখে তিনি বাধা দিতে সাহস পাননি।

পুলিশ সূত্রের খবর, খুন করার পরেও সে ভাবে ভেঙে পড়েননি রণেনবাবু। নীচের ভাড়াটেকে সব বলে নিজেই ঘরে গিয়ে জামাকাপড় পড়ে ওষুধের ব্যাগ গুছিয়ে থানায় রওনা দিয়েছিলেন। যদিও তার আগেই পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেফতার করে।

পুলিশ জানায়, সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ জল তোলা নিয়ে রণেন্দ্রবাবুর সঙ্গে সুমনবাবুর গোলমাল হয়। শুরু হয় হাতাহাতি। দুই বৃদ্ধের মারামারি, চিৎকার শুনে মধুশ্রীদেবীর এক ভাড়াটে উপরে গিয়ে একটা নাগাদ গোলমাল থামান। পুলিশ জেনেছে, বেলা দেড়টা নাগাদ সুমনবাবু খেতে বসেন। সেই সময় ফের বচসা বাধে। আচমকাই রণেন্দ্রবাবু রান্নাঘর থেকে একটি ছুরি এনে সুমনবাবুর বুকে-পেটে কোপাতে থাকেন। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সুমনবাবুর বুকে দুটি এবং তলপেটে তিনটে ছুরির আঘাত মিলেছে। ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা বলছেন, “আঘাতের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, প্রতিহিংসাবশতই খুন করা হয়েছে।”

পুলিশ জানায়, খুনের পরে রণেন্দ্রবাবু নিজেই ভাড়াটেদের কাছে খুনের কথা জানান। তত ক্ষণে মধুশ্রীদেবী শিলংয়ে ঘুরতে যাওয়া তাঁর ছেলেকে ফোনে সব জানান। মধুশ্রীদেবীর ছেলে তাঁর পরিচিত বন্ধু আইনজীবী দিব্যেন্দু ভট্টার্চাযকে ফোনে বিষয়টি জানান। দিব্যেন্দুবাবু এসে দেখেন, রণেন্দ্রবাবু থানায় যাচ্ছেন। তিনি অন্যদের সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধকে আটকে টালিগঞ্জ থানায় খবর দেন। পুলিশ জানায়, ওই বাড়িতে মধুশ্রীদেবীর ছেলে-মেয়েও থাকেন। তবে তাঁরা এ দিন বাড়ি ছিলেন না। খবর পেয়ে সন্ধ্যায় সুমনবাবুর পরিবারের লোকেরাও মধুশ্রীদেবীর বাড়িতে আসেন। কিন্তু তাঁরা কিছু বলতে চাননি।

ঘটনাটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বার্ধক্য বিশারদ (জেরেন্টোলজিস্ট) ও মনোবিদেরাও। জেরেন্টোলজিস্ট ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী বলছেন, “সাধারণত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অপরাধের শিকার হন। কিন্তু এই বয়সে এক জন বৃ্দ্ধ খুন করছেন, এটা খুব বিরল ঘটনা।” এই ঘটনার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে রণেন্দ্রবাবুর জিনগত ও পরিবেশগত তথ্য প্রয়োজন বলেও তিনি জানান।

এই ঘটনাকে ব্যতিক্রমী বলেছেন মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম। তিনি বলছেন, অনেক সময় অসুস্থ অবস্থায় কোনও বৃদ্ধ নিজের স্ত্রী বা পুত্রকে খুন করছেন, এটা তবুও দেখা যায়। কিন্তু প্রতিহিংসাবশত এক বৃদ্ধ খুন করছেন, এটা অস্বাভাবিক। “বয়স্করা অনেক সময় নানা কারণে রেগে যান। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের হয়। এতটা মারাত্মক ফল তাতে দেখা যায় না,” বলছেন জয়রঞ্জনবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

suman ghosh murder ranendra roy madhushri nag
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE