Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কমছে জমি, ব্যবসা বাঁচাতে থাবা তাই অন্যের ‘ভাগে’

নিউ টাউন যে ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসায়ীদের কাছে খনি, তা ওই এলাকায় ঘুরলেই স্পষ্ট হয়। প্রায় প্রতিটি পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে ছোটখাটো সিন্ডিকেট। এ যেন বিন্দুর সমাহারে সাগর গড়ে ওঠা! সেই সাগরের উথালপাথাল ঢেউয়েই নাজেহাল নিউ টাউন। কোথাও সেই ‘সাগরের’ নাম ‘আপনজন’, কোথাও বা ‘লোকাল বয়েজ’। কোথাও আবার পাড়াসুদ্ধ লোকের নামেই গড়ে উঠেছে ‘গ্রামবাসী এন্টারপ্রাইজ’।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
আর্যভট্ট খান শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৪ ০২:২৩
Share: Save:

নিউ টাউন যে ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসায়ীদের কাছে খনি, তা ওই এলাকায় ঘুরলেই স্পষ্ট হয়। প্রায় প্রতিটি পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে ছোটখাটো সিন্ডিকেট। এ যেন বিন্দুর সমাহারে সাগর গড়ে ওঠা! সেই সাগরের উথালপাথাল ঢেউয়েই নাজেহাল নিউ টাউন।

কোথাও সেই ‘সাগরের’ নাম ‘আপনজন’, কোথাও বা ‘লোকাল বয়েজ’। কোথাও আবার পাড়াসুদ্ধ লোকের নামেই গড়ে উঠেছে ‘গ্রামবাসী এন্টারপ্রাইজ’। রীতিমতো দাদাগিরির ঢঙেই নিউ টাউনকে কার্যত টাকার খনিতে পরিণত করেছেন এই সব সিন্ডিকেটের সদস্যেরা। বাড়ি করতে চাইলে ইমারতি দ্রব্য নিতে হবে এদের থেকেই।

অ্যাকশন এরিয়া ১-এর বিধাননগর পুলিশের এডিসিপি-র অফিস ছাড়িয়ে একটু এগোলেই বাঁ হাতে ‘আপনজন’-এর অফিস। তার পরেই বাঁ হাতে একের পর এক ইমারতি দ্রব্যের দোকান। রাস্তার ধারে কাঠ-টিনের ছ’ফুট বাই ছ’ফুটের দোকান। সেগুলির সাইনবোর্ডে শুধুই নাম আর ফোন নম্বর লেখা। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ইট-বালি-পাথরের জন্য ওই নম্বরে শুধু একটা ফোন করলেই হবে। বাকিটা...।

কিন্তু কেন এমন রমরমা সিন্ডিকেটের?

নিউ টাউনের বিভিন্ন এলাকায় গজিয়ে উঠছে একের পর এক বহুতল। সেগুলিতে ইট-বালি-পাথর সরবরাহ করতে পারলেই আদায় হবে মোটা টাকা। এ ছাড়াও রয়েছে ‘উপরি’ আয়। একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত এক যুবকের বক্তব্য, “৫০০ ঘনফুট বালির অর্ডার থাকে। কিন্তু পুরোটা তো দেওয়া হয় না।” একটি গাড়িতে ১০০ ঘনফুট কম দিলেই থোক হাজার তিনেক টাকা বেশি আয়। অভিযোগ, সিন্ডিকেটের দাদাগিরির ভয়ে বালি-পাথরের কম পরিমাণ নিয়ে কেউ সরব হতেও সাহস পান না।

এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন নিউ টাউন অ্যাকশন এরিয়া ২-এর একটি নির্মীয়মাণ আবাসনের একজন কর্মী। তাঁর কথায়, “প্রতিবাদ করলে সেই সাইটে লরি ঢোকাই বন্ধ করে দেবে ওরা। পুলিশকে জানিয়েও লাভ নেই।” শুধু পরিমাণেই কম নয়, নিম্ন মানের জিনিসও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয় বলে অভিযোগ।

মহিষবাথানের থাকদাঁড়ি এলাকার এক সিন্ডিকেটের চাঁই শোনালেন এমন আরও একটি ঘটনা। ওই এলাকায় একটি সমবায় আবাসন তৈরি করছিলেন কয়েক জন সরকারি অফিসার। সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ইমারতি দ্রব্য কিনতে গিয়ে আঁতকে উঠেছিলেন তাঁরা। এত খারাপ জিনিস দিয়ে বাড়ি তৈরি করলে কী হাল হবে? শেষমেশ ওই সিন্ডিকেট চাঁইয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তাঁরা। শেষে ওই চাঁইয়ের মধ্যস্থতাতেই নিজেরা মালপত্র কিনতে পারেন তাঁরা।

কিন্তু গোল বেধেছে অন্যত্র। নিউ টাউনে ক্রমশ বাড়ছে বহুতল, কমছে জমি। পালাবদলের পরে বেড়েছে সিন্ডিকেটের সংখ্যাও। ফলে ব্যবসার জমি দখল ঘিরে বাড়ছে সংঘর্ষ।

নিউ টাউনের পুরনো সিন্ডিকেটের লোকেরা বলছেন, এক সময়ে সিন্ডিকেটের এলাকা ভাগ করা ছিল। কিন্তু ক্রমশ জায়গা কমতে থাকায় সেই ভাগ মুছে গিয়েছে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্তেরা বলছেন, “আমাদের এলাকায় হয়তো নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে না। অন্যের এলাকায় হচ্ছে। এমন হলে আমাদের ভাগ্যে তো বরাত-ই জুটবে না। ব্যবসাও লাটে উঠবে।” তাই এখন একে অন্যের এলাকায় ঢুকে ব্যবসা করতে চাইছে। বাড়ছে গোলমাল।

এই পরিস্থিতিতেই ছোটখাটো সিন্ডিকেটগুলি আশ্রয় নিচ্ছে ‘বড় ছাতা’র তলায়। ব্যবসা না বাড়লেও এতে দুর্দিনে টিঁকে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। বিনিময়ে কেবল দিতে হয় নজরানা। রামকৃষ্ণপুর এলাকার এক সিন্ডিকেটকর্মী বললেন, “একটা বড় সিন্ডিকেটকে টাকা দিলেই চলে না। এলাকার দুই ‘দাদা’কেই টাকা দিতে হয়।”

কারা এই ‘দাদা’?

এখানেও ঘুরে ফিরে উঠে এসেছে ভজাই, রুইস ও আফতাবউদ্দিনের নাম। তৃণমূলের একাংশ জানান, ভজাই নিউ টাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের ঘনিষ্ঠ। এলাকার পুরনো তৃণমূল বলে পরিচিত আফতাব রয়েছেন বিরোধী সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের গোষ্ঠীতে। লোকসভা ভোটের আগে তাঁর সভাতেই রুইসকে দেখা গিয়েছিল। নিউ টাউনের এই দুই চাঁইয়ের লড়াইয়েই সিন্ডিকেট গোলমাল লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। কাকলিদেবী অবশ্য বারবারই দাবি করেছেন, রুইসের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই।

একে অন্যের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করেছেন ভজাই ও আফতাব। ভজাইয়ের বক্তব্য, “আফতাব সিন্ডিকেটের নামে জোর করে তোলাবাজি চালাচ্ছে।” ভজাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিধায়কও। তিনি বলেন, “ভজাই কোনও দিন কাউকে একটা চড়ও মারেনি। ওঁর নামে কোনও অভিযোগ নেই।” অভিযোগ অস্বীকার করে আফতাব পাল্টা বলেন, “নিউ টাউনের পুরো সিন্ডিকেটের দখলদারি নিতে চাইছে ভজাই। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা মেনে নিতে চাইছেন না। তাই মাঝে মধ্যেই গণ্ডগোল হচ্ছে।”

নিউ টাউনের সাধারণ মানুষ অবশ্য বলছেন, সিন্ডিকেট আসলে রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ের হাতিয়ার। তাই গোলমাল শুধু ভজাই-আফতাবের নয়। গোলমাল এখানে ‘দাদা’র সঙ্গে ‘দাদা’র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE