Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কিশোরীর পেটে মিলল ৫ কেজির টিউমার

ক্লাস নাইনের পিয়া দাস খেতে পারত না মোটে। এক গ্রাস ভাত কিংবা আধখানা রুটি খেয়েই নাকি পেট ভরে যেত মেয়ের। জোর করে খাওয়াতে গেলেই কান্নাকাটি, সঙ্গে বমি। একদিন শুরু হল পেটে অসহ্য যন্ত্রণা।

পিয়া দাস

পিয়া দাস

সৌভিক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ০১:৩৪
Share: Save:

ক্লাস নাইনের পিয়া দাস খেতে পারত না মোটে। এক গ্রাস ভাত কিংবা আধখানা রুটি খেয়েই নাকি পেট ভরে যেত মেয়ের। জোর করে খাওয়াতে গেলেই কান্নাকাটি, সঙ্গে বমি। একদিন শুরু হল পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। শেষে অস্ত্রোপচার করে তার পেট থেকে বার করা হল প্রায় পাঁচ কেজির এক টিউমার! হতবাক্ পিয়ার পরিজনেরা। অবাক চিকিৎসকেরাও।

পিয়ার মামা প্রদীপ নাথ জানান, মাস ছয়েক ধরে পিয়ার তলপেটে অস্বস্তি হত। শেষের তিন মাস সে প্রায় কিছুই খেত না। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে বিবিধ হজমের ওষুধ খাইয়েও লাভ হয়নি। ওজন কমে যাচ্ছিল হু-হু করে। এর মধ্যেই একদিন বাড়িতে পড়ে যায় পিয়া। তার পরেই শুরু হয় পেটে যন্ত্রণা।

প্রদীপবাবু জানাচ্ছেন, স্থানীয় চিকিৎসক প্রথমে গ্যাসের ব্যথা ভেবে ইঞ্জেকশন দেন। কিন্তু ব্যথা বাড়তেই থাকে। বেগতিক দেখে পিয়াকে ভর্তি করা হয় ইএসআই জোকায়। এক্স-রে করে দেখা যায়, পিয়ার পেটে বড় একটি মাংসের ডেলা রয়েছে। কিন্তু বায়োপ্সিতেও কিছু ধরা পড়েনি। ও দিকে পিয়ার অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাকে ভর্তি করা হয় বাইপাসের ফর্টিস হাসপাতালে। সেখানেই এক জটিল অস্ত্রোপচারের পরে সুস্থ হয় পিয়া।

কী হয়েছিল পিয়ার? গ্যাস্ট্রো এবং এইচপিবি (হেপাটো প্যাংক্রিয়াটিকো বিলিয়ারি) সার্জেন শুদ্ধসত্ত্ব সেন জানাচ্ছেন, পিয়ার লিভারের বাম খণ্ডে বিরাট টিউমার হয়েছিল এবং সেটির ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ডাক্তারি পরিভাষায় এর নাম ‘হেপাটিক প্রাইমারি আনডিফারেনশিয়েটেড এমব্রায়োনাল সারকোমা’ (যকৃতের এক বিশেষ এবং অস্বাভাবিক ক্যানসার)। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৪ বছরের মেয়ের এই ধরনের ক্যানসার বিরল এবং অস্বাভাবিক।

শুদ্ধসত্ত্ববাবু জানাচ্ছেন, সিটি স্ক্যান করে প্রথমে এই টিউমারটিকে ‘হেপাটোব্লাস্টোমা’ ভাবা হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, পিয়ার সমস্যা আরও জটিল। টিউমারটি অনেক দিন ধরেই বাড়তে বাড়তে পিয়ার পুরো পেটের দখল নিয়ে নিয়েছিল। পাকস্থলী এবং অন্ত্রের উপরেও ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করেছিল। তাই সামান্য খেলেই পেট ভরে যেত পিয়ার। তিনি বলেন, ‘‘অস্ত্রোপচার ছাড়া পিয়াকে বাঁচানোর উপায় ছিল না। তবে রীতিমতো কঠিন ছিল কাজটা। আমরা নিজেরাও বেশ সংশয়ে ছিলাম। সে কারণেই আমরা ২৪ বোতল রক্ত জোগাড় করে রেখেছিলাম। কারণ বেশি রক্তপাত হলেই পিয়ার হার্ট ফেল করার সম্ভাবনা ছিল। অপারেশন থিয়েটার নেওয়া হয়েছিল ছ’ঘণ্টার জন্য।’’

নার্সিংহোম সূত্রে খবর, অস্ত্রোপচারের পরে পিয়ার পেট থেকে বেরোয় প্রায় পাঁচ কেজির টিউমারটি। সব মিলিয়ে ৯০টি সেলাই পড়ে। যদিও ২৪ বোতল রক্ত এনে রাখা হয়েছিল, কিন্তু দরকার পড়েনি। তবে যকৃতে এত বড় টিউমারের কথা এর আগে শুনেছেন বলে মনে করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞেরা।

কিন্তু কেন হয় এই ধরনের টিউমার?

চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী জানাচ্ছেন, যকৃৎ ব্যাপারটাই খুব গোলমেলে। মানবদেহের যত আদিম কোষগুলির ঘাঁটি ওখানেই। তাই সঠিক কারণ নির্ণয় করা বেশ মুশকিল। তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের অসুখে রোগ নির্ণয় করাটাই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। লিভার যতক্ষণ ভাল তো ভাল, কিন্তু খারাপ হলেই মুশকিল।’’

শুদ্ধসত্ত্ববাবুও জানাচ্ছেন, ‘হেপাটোব্লাস্টোমা’ সাধারণত তিন-চার বছরের বাচ্চাদের হয়। আর ১৪ বছর বয়সে ‘এমব্রায়োনাল সারকোমা’ তো আরও বিরল। কারণ মানুষের দেহে ভ্রূণাবস্থায় যে কোষগুলি থাকে, সেগুলি পরে সুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু পিয়ার ক্ষেত্রে সেগুলি থেকেই টিউমারটি হয়। শুদ্ধসত্ত্ববাবু বলেন, ‘‘ক্যানসার সাধারণত রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। পিয়ার টিউমারটি এক জায়গাতেই ছিল, ছড়িয়ে পড়েনি। তাই আমাদের কাজ কিছুটা সহজ হয়েছে।’’ অস্ত্রোপচারের চার দিন পরেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে পিয়া। এখন অনেকটাই সুস্থ সে। খাওয়ার ইচ্ছা ফিরেছে। মায়ের কাছে এখন খাবার চেয়ে খাচ্ছে মেয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE