Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

থানা ঘেরাওয়ের ভয়ে প্রতাপ দমনে অনীহা

মাস পাঁচেক আগেকার এক ঘেরাও-হামলার কালি আলিপুর থানার মুখ থেকে এখনও মোছেনি। কবে মুছবে, আদৌ মুছবে কি না— কেউ জানে না। এই অবস্থায় আরও এক বার থানা ঘেরাওয়ের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না পুলিশের বড় কর্তারা। সেই জন্যই তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহা এবং তাঁর শাগরেদদের গারদে পুরতে এত গড়িমসি। এই যুক্তি কলকাতা পুলিশের শীর্ষ মহলের।

প্রতাপ সাহা

প্রতাপ সাহা

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

মাস পাঁচেক আগেকার এক ঘেরাও-হামলার কালি আলিপুর থানার মুখ থেকে এখনও মোছেনি। কবে মুছবে, আদৌ মুছবে কি না— কেউ জানে না। এই অবস্থায় আরও এক বার থানা ঘেরাওয়ের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না পুলিশের বড় কর্তারা। সেই জন্যই তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহা এবং তাঁর শাগরেদদের গারদে পুরতে এত গড়িমসি।

এই যুক্তি কলকাতা পুলিশের শীর্ষ মহলের। আলিপুর থানার এক অফিসার জানাচ্ছেন, প্রতাপ এবং তাঁর দলবলকে গ্রেফতার করলে শাসক দলের তরফে আলিপুর থানা ঘেরাও করা হতে পারে বলে গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিয়েছেন। থানাকে তা জানিয়েছে লালবাজার। তাই কলকাতার পুরভোট মিটলেই প্রতাপ-দমনে নামার জন্য আট ঘাট বাঁধা হলেও কাজটা এগোয়নি।

অথচ পুলিশেরই দাবি, আলিপুরের গোপালনগর মোড়ে বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের সভায় হামলার সিসিটিভি ফুটেজে সে-দিন ঘটনাস্থলে প্রতাপের উপস্থিতি ধরা আছে। আলিপুর থানার এক অফিসার বলেন, ‘‘সিসিটিভির ফুটেজ দেখে আমরা প্রতাপ-সহ চার জনকে শনাক্ত করেছিলাম। কিন্তু এ-পর্যন্ত এক জনকেও ধরা গেল না।’’ শুধু তো রূপার সভায় হামলা নয়। সে-দিন পুলিশকেও নিগ্রহের মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই ঘটনার সাত দিন পরেও প্রতাপ বা অন্য কোনও অভিযুক্তকে গ্রেফতার না-করায় ওই থানার নিচু তলায় ক্ষোভ দানা বাঁধছে।

পুলিশের নিচু তলার অভিযোগ, প্রতাপ কলকাতার পুরভোটের দু’দিন আগে থেকে গা-ঢাকা দিলেও তাঁর চার সঙ্গীকে নির্বাচনের দিনেও এলাকায় দেখা গিয়েছে। কিন্তু তবু তাদের ধরা হল না কেন, প্রশ্ন উঠছে পুলিশেরই অন্দরমহলে।

পুলিশের একাংশের বক্তব্য, অভিযুক্তেরা শাসক দলের লোক এবং প্রবল প্রতাপশালী। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, প্রতাপকে গ্রেফতার করলে এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে এবং একা থানার পক্ষে সেটা সামলানো সম্ভব হবে না। কেন? গোয়েন্দারা জানান, ওই এলাকায় প্রতাপের প্রভাব অন্য নেতাদের থেকে বেশি। তিনি ২০টিরও বেশি বস্তি ও ক্লাবের নেতা। ওই সব বস্তি ও ক্লাবে প্রতাপের কথাই শেষ কথা। প্রতাপকে ধরলে সেখানকার বাসিন্দা ও সদস্যেরা থানাকে নিশানা করবে। থানার পক্ষে সেটা সামলানো সম্ভব না-ও হতে পারে মনে করছে পুলিশের ওই অংশ।

গত ১৪ নভেম্বর আলিপুর থানা ঘেরাওয়ের নাম করে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা কী কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, থানার কর্মী-অফিসারেরা তা ভুলতে পরেননি। সেই হামলায় মাথা বাঁচাতে ফাইলকে ঢাল করে পুলিশকে টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়তে দেখা গিয়েছিল। থানা সূত্রের খবর, তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতেই প্রতাপ এবং তাঁর দলবলকে ধরা হচ্ছে না বলে আলিপুর থানাকে জানিয়েছে উপর তলা।

পুলিশের উপর তলা অবশ্যই এই কারণটাকে সরাসরি স্বীকার করে নিচ্ছে না। লালবাজার সূত্রে দাবি করা হয়েছে, প্রতাপের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না বলেই তাঁকে ধরা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রতাপের যে-চার সঙ্গীকে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্ত করা গিয়েছে, তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? লালবাজারের ওই সূত্রের ব্যাখ্যা, প্রতাপকে ধরার পরেই তাঁর সঙ্গীদের গ্রেফতার করা হবে। ওই সঙ্গীদের যে ছেড়ে রাখা হচ্ছে, তার কারণ, তাদের মাধ্যমে নজরদারি চালানো হচ্ছে প্রতাপের গতিবিধির উপরেই।

আলিপুর থানার নিচু তলা অবশ্য উপর তলার এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নয়। থানার এক অফিসার বলেন, ‘‘আমরা মার খাব আর কর্তারা আজেবাজে যুক্তি দেবেন, তা হতে পারে না। এই জন্যই তো দুষ্কৃতীদের এত বাড়বাড়ন্ত। এই জন্যই তো গিরিশ পার্কে পুলিশকে গুলি চালাতে সাহস পায় শাসকের আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীরা!’’ নিচু তলার পুলিশকর্মীদের অভিযোগ, লালবাজারের কর্তারা চাইলে গুন্ডা দমন শাখাকে দিয়ে খুব সহজেই প্রতাপকে গ্রেফতার করাতে পারেন। কিন্তু তাঁরা সেটা চান না বলেই প্রতাপ এখনও অধরা।

লালবাজার এই অভিযোগ মানতে চায়নি। তারা অধস্তনদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলছে। কেন ধৈর্য ধরতে হবে, সেটাই মাথায় ঢুকছে না পুলিশের নিচু তলার। প্রতাপের হদিস নেই বলেই তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, কর্তাদের এই যুক্তিও মানছে না তারা। কারণ, ভোটের দিনেও তিনি এলাকাতেই ছিলেন এবং নেপথ্যে থেকে ভোট পরিচালনা করেছেন। আলিপুরের যে-জায়গায় প্রতাপ ও তাঁর সঙ্গীদের ডেরা, সেখানকার বেশ কিছু মানুষ জানান, রূপার সভায় হামলার পরে অন্তত তিন দিন সব অভিযুক্তই এলাকায় ছিল। এখন তারা কেউ কামারহাটি, কেউ বা টিটাগড়, ব্যারাকপুরে দলীয় প্রার্থীদের হয়ে খাটতে গিয়েছে। প্রতাপ ছাড়া বাকি চার জনের পরিচয় কী?

আলিপুর থানা জানাচ্ছে, ওদের বিরুদ্ধেই নভেম্বরে আলিপুর থানা ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছিল। সেই মামলার চার্জশিটেও প্রতাপ ছাড়া বাকি অভিযুক্তদের নাম আছে। থানায় হামলার অভিযোগের মামলাতেও ধরা হয়নি ওই চার জনকে।

লালবাজার সূত্রের খবর, রূপা কাণ্ডে তিনটি মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারি নিয়ে পুলিশে বিরোধ আছে। তিনটির মধ্যে আলিপুর থানার ওসি-সহ পুলিশকর্মীদের কাজে বাধা ও ধস্তাধস্তির মামলাটি নিজের থেকেই দায়ের করেছে পুলিশ। পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের মত, গ্রেফতার করতে হলে দু’পক্ষের যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, তাঁদের সকলকে গ্রেফতার করতে হয়। কিন্তু তা আবার মানতে রাজি হননি তদন্তকারীরা।

পুলিশের নিচু তলার প্রশ্ন, রূপার সভায় হামলা ছাড়াও ওই সভায় পুলিশ-নিগ্রহ এবং আলিপুর থানায় পুলিশের উপরে আক্রমণের ঘটনায় প্রতাপদের রেয়াত করা হচ্ছে কেন? এতে কি পুলিশের ভাবমূর্তিতে আরও কালি লাগছে না? এতে কি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না, পুলিশের উপরে হামলা চালিয়েও পার পাওয়া যায়? অনায়াসে গুলি চালিয়ে দেওয়া যায় পুলিশের বুকে? যেমন চালানো হয়েছে গিরিশ পার্ক থানার সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডলের বুকে?

লালবাজারের উঁচু তলা হাত গুটিয়ে থাকায় নিচু তলায় এই সব প্রশ্নেই ধূমায়িত হচ্ছে ক্ষোভ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE