Advertisement
১১ মে ২০২৪

নবাবি স্বাদে জাগছে কলকাত্তাইয়া লখনউ

নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের জনৈক উত্তরপুরুষকে প্রশ্নটা করেছিলেন খোদ সত্যজিৎ রায়। তখন ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র শ্যুটিং চলছে। সত্যজিতের প্রশ্ন, ‘নবাবসাহেবের কী হয়েছিল বলুন তো! দেশে এত জায়গা থাকতে নির্বাসনপর্বে এই উর্দু-অশিক্ষিত কলকাতাকে তিনি কেন বেছে নিলেন?’

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৩৬
Share: Save:

নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের জনৈক উত্তরপুরুষকে প্রশ্নটা করেছিলেন খোদ সত্যজিৎ রায়।

তখন ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র শ্যুটিং চলছে। সত্যজিতের প্রশ্ন, ‘নবাবসাহেবের কী হয়েছিল বলুন তো! দেশে এত জায়গা থাকতে নির্বাসনপর্বে এই উর্দু-অশিক্ষিত কলকাতাকে তিনি কেন বেছে নিলেন?’

নবাবের সেই উত্তরপুরুষ জবাবটা দিয়েছিলেন মোক্ষম। ‘আপনি বলুন তো, দেশে এত নামজাদা সব ফিল্ম ডিরেক্টর থাকতে কারও কখনও কেন ওয়াজিদ আলি শাহকে নিয়ে ছবি করার কথা মাথায় এল না! কেন আপনিই প্রথম...!’

শুনে হেসে ফেলেন সত্যজিৎ। আজকের বিরিয়ানিখোর বাঙালিকে দেখলেও হয়তো নবাব সাহেবের মনে হতো, কলকাতাকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ‘গলত’ ছিল না! নবাবের সেই সাধের মেটিয়াবুরুজ খণ্ডহর হতে পারে! কিন্তু ছোট ছোট লখনউ যেন গড়ে উঠছে শহরের বিভিন্ন মহল্লায়।

দেশপ্রিয় পার্ক বা সল্টলেকের কোনও পাড়ার সঙ্গে অন্তত ‘বাদশাহি আংটি’র শহরের কোনও টুকরো মেলানোর কথা স্বপ্নেও ভাবেনি বাঙালি। কিন্তু বাস্তবিক, তেমনটাই ঘটছে। এই তো সিটি সেন্টারের খিড়কির দিকে সল্টলেকের সিডি ব্লকের সে-দরজা ঠেললেই জেগে উঠছে হজরতগঞ্জ-আমিনাবাদের সাবেক মহল্লা। ঘরময় চোখ জুড়োনো জাফরির কাজ। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র খানদানি টেবিল-টপ-এর শোভা! এ উমরাওজানের দরবার না নবাবসাহেবের খাসমহল, গুলিয়ে দিয়েই সেজে উঠেছে এক আনকোরা রেস্তোরাঁ।

‘‘বিরিয়ানি-পাগলদের রসনায় ধাক্কা দিতে এই লখনউভি থিমটাই শহরে নতুন টেক্কা!’’— বলছিলেন, সল্টলেকের খুদে লখনউ তথা ‘অউধ ১৫৯০’-এর কর্ণধার দু’ভাই শিলাদিত্য ও দেবাদিত্য চৌধুরী। কলকাতার ট্রেডমার্ক আলুখচিত বিরিয়ানির চেনা ছকের বাইরে নবাবি খানার সুগন্ধে এ অন্য উড়ান। লখনউভি আবহই সে রাজভোগের যোগ্য পটভূমি। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে ‘থিম লখনউ-এর পত্তন ঘটায় অউধ-১৫৯০। সেলুলয়েডের শিল্পনির্দেশক নীতীশ রায়ের তত্ত্বাবধানে জমজমাট সল্টলেকের লখনউ।

একদা লখনউয়ি বিরিয়ানিকে যে শহর তার নিজের মতো করে বদলে নিয়েছিল, তার কাছে এ যেন উলটপুরাণ। সিরাজ-এর কর্ণধার ইশতিয়াক আহমেদ বলছেন, কলকাতায় আলু ছাড়া বিরিয়ানি পাকানো সত্যিই স্পর্ধা! কিন্তু মার্কোপোলো রেস্তোরাঁর কর্পোরেট ম্যানেজার কল্লোল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘কলকাতা ক্রমশ খোলা মনে অন্য ধরনের বিরিয়ানিকে মেনে নিতে শিখছে।’’ মার্কোপোলো, ট্যামারিন্ড বা দক্ষিণ কলকাতার আর একটি বিরিয়ানি চেন ‘খোয়াব’-এও ঢুকে পড়েছে হায়দরাবাদি বিরিয়ানি! তাতেও আলুর নামগন্ধ নেই। বিরিয়ানি হেভিওয়েট আরসালান-কর্তাদের মতে, বিরিয়ানিতে কলকাতা-ঘরানাই শেষ কথা। তবু অন্য ধাঁচের বিরিয়ানিকে তাঁরাও একেবারে অগ্রাহ্য করছেন না।

তবে সাবেক যুগ থেকে চিৎপুরের রয়্যাল হোটেলই আলুবিহীন হলুদবরণ রাজকীয় লখনউভি বিরিয়ানির ঘরানায় একনিষ্ঠ থেকেছে। অউধের খুদে লখনউ কলকাতাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ধ্রুপদী ঘি-সুরভিত নবাবি খানার রেশ ।

কলকাতার গড়পরতা রেস্তোরাঁয় বিরিয়ানির সঙ্গী রেজালা, স্টু বা চাঁপ। এ তল্লাটে মাটন চাঁপের সমান আদর মাহি চাঁপের। আবার খাসির মগজ বা ব্রেন কোর্মারও জয়জয়কার। বিরিয়ানি ঝরঝরে ঘিয়ে পাকানো! নজর কাড়ছে পুঁচকে মাংসের গুল্লি ভরপুর মোতি বিরিয়ানি ও মাটন রান বিরিয়ানি। তাতে খসে পড়েছে খাসির ঠ্যাংয়ে লেগে থাকা অনেকটা কমনীয় মাংসের পরত। কবাবে রয়েছে কাকোরি, গলৌটির সম্ভার।

চাখতে বসে বহু বাঙালির গোমতীপারের ‘তুণ্ডেওয়ালি’ কবাব-শিল্পীর হাতযশ মনে পড়ে যায়। শহরের ‘লখনউ’য়ের জৌলুসে গোমতী ও গঙ্গা-র ‘গ’ যেন গুলিয়ে যাচ্ছে এখন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE