ফেসবুকে এক কবির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সদ্য বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলার। আলাপ ক্রমশ গড়ায় প্রেমে। বিয়েও ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের ঠিক আগেই মহিলা জানতে পারেন, তাঁর হবু বর আদৌ কবি নন। তাঁর বিয়েও হয়ে গিয়েছে। এর পরেই ঝগড়াঝাঁটি শুরু। অভিযোগ, রাগ মেটাতে ফেসবুকেই ওই মহিলার সম্পর্কে কুৎসা ছড়াতে শুরু করেন সেই ভুয়ো কবি। হেনস্থার হাত থেকে বাঁচতে শেষ পর্যন্ত পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন ওই মহিলা।
রোজকার জীবনযাপনে এখন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছে সাইবার দুনিয়া ও প্রযুক্তি। নিত্যদিন ফেসবুক ব্যবহার করেন না, এমন শহুরে মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। কিন্তু তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধের সংখ্যাও। একই ইঙ্গিত মিলেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর সর্বশেষ রিপোর্টেও। সাইবার-বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বর্তমানে ইন্টারনেট কিংবা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটকে বাদ দিয়ে চলা সম্ভব নয়। কিন্তু একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে নিরাপত্তার দিকটাও। তা না হলে বন্ধুত্বের ফাঁদে বিপদে ফেলতে পারে দুষ্কৃতীরা। কেষ্টপুরের বধূ সোমা ঘোষের খুনের ক্ষেত্রেও একই তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই ঘটনায় অভিযুক্তের সঙ্গে ফেসবুকেই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সোমাদেবীর।
মনোবিদেরা বলছেন, মানুষের সামাজিক মেলামেশার পরিসর এখন ছোট হয়ে এসেছে। বেড়েছে সাইবার জগতে ‘ভার্চুয়াল’ বন্ধুত্ব। ইন্টারনেটে হনলুলু থেকে হলদিয়া জুড়ে যাওয়ায় ঘরে বসে দূরের অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে অবসর ভাগ করে নেওয়া যাচ্ছে। গোলযোগটাও সেখানেই। মনস্তত্ত্ববিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, এই জগৎটা একটা কল্পনা বা ফ্যান্টাসির মতো। তাই সেখানে বেশি সময় কাটালে বাস্তববোধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মানুষ। “এখানে বন্ধুত্ব পাতিয়ে কাউকে ব্যক্তিগত জগতে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন নেই। ফেসবুক যাতে নেশা না হয়ে দাঁড়ায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।”—বলছেন তিনি।
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেট-বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতেই নিজের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে ফেলছেন অনেকে। বহু ক্ষেত্রে সেই তথ্য কাজে লাগিয়েই ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বন্ধুর মুখোশের আড়ালে থাকা দুষ্কৃতীরা। কখনও কখনও রাগ মেটাতেও ব্যক্তিগত তথ্য কুৎসার আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে। সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা পুলিশ অফিসারেরা বলছেন, বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলে এমন হেনস্থার শিকার মহিলারাই বেশি হন। যেমনটা ঘটেছে কেষ্টপুরে।
কিন্তু সাইবার জগতে অপরিচিতেরা বন্ধু হবেন, এটাই তো স্বাভাবিক! তা ছাড়া, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকার এটা সুবিধাও। এ কথা মেনে নিচ্ছেন সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞেরাও। তবে তাঁরা বলছেন, সাইবার জগতের বন্ধুদের সঙ্গে বাস্তব জগতের সম্পর্ক নেই, এটাও মাথায় রাখতে হবে। তাই টুকটাক আড্ডা চলতে পারে, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বা ব্যক্তিগত তথ্য আদানপ্রদান করা চলবে না। মাথায় রাখতে হবে সাইবার জগতে ভুয়ো অ্যাকাউন্টের কথাও।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ বলছেন, ইদানীং বহু ব্যবহারকারীই ফেসবুক বা অন্যান্য সাইটে নাম বা পরিচয় ভাঁড়িয়ে অ্যাকাউন্ট খোলেন। ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খোলা এ সব দুষ্কৃতীরাই মহিলাদের সঙ্গে গল্প করার সময় নানা অছিলায় ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি হাতিয়ে নেয়। তার পরে তা ফাঁস করার হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেল করে। সোমাদেবীর ক্ষেত্রেও তেমন হয়েছিল কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় জানান, ইন্টারনেট ব্যবহারে সড়গড় না হয়েই অনেকে ফেসবুক বা অন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহার করছেন। ফলে জালিয়াত ও দুষ্কৃতীদের ফাঁদ বুঝতে পারছেন না তাঁরা। কখনও আবার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের পদ্ধতিগত ভুলেও সুযোগ পায় দুষ্কৃতীরা। কী ভাবে?
বিভাসবাবুর ব্যাখ্যা, একই লোক ফেসবুকে নানা নামে অ্যাকাউন্ট খুলছে। কিন্তু সেটা যাচাই করার মতো পদ্ধতি নেই। সেই সুযোগেই দুষ্কৃতীরা একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে অপরাধ করছে বলে তাঁর দাবি। এ ক্ষেত্রেও নজরদারি কড়া হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিভাসবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy