‘সাইকো’-য় এক অনামী রহস্য এসে উপস্থিত হয়েছিল। সেই রহস্য ব্যক্তিবিশেষের বিকার নয়। ফ্রয়েড বলেছিলেন, যদি তাত্ত্বিক ভাবে দেখা যায়, বা পুলিশের চোখ দিয়ে অপরাধের মাত্রাকে না দেখি, তা হলে দেখা যাবে, আমরা সকলেই বিকারগ্রস্ত।
এই যে আজ শেক্সপিয়ার সরণি থানা এলাকার রবিনসন স্ট্রিটের অপরাধ, বলতে পারি, এটা কলকাতার নগরায়নের প্রতিক্রিয়া। গত পনেরো বছরে অপরিকল্পিত ভাবে কলকাতা শহরটা যে ভাবে পাল্টে গেল, তাতে অপরাধের ধরনও পাল্টে গেল। যদি ব্যোমকেশের কথা ভাবি, তা হলে ব্যোমকেশ এ শহরে প্রথম পা দেয় ১৯৩৩ সালে। সে লুকিয়ে দেখে অপরাধের চরিত্র পাল্টাচ্ছে। এই শহর ক্রমাগত ইশ্বরহীন হয়ে যাচ্ছে ওই তিরিশ ও চল্লিশের দশকে। মৃত বিশ্বাসের সঙ্গে জীবিত মানুষের সমঝোতা করিয়ে দেওয়ার জন্য ইশ্বরের বদলে দরকার হয়েছিল এক গোয়েন্দার। জীবনানন্দ দাস প্রায় একই সময়ে তাঁর কবিতায় মানুষের ‘দ্বিতীয় কোনও মরণ’ সম্বন্ধে আতঙ্কিত হয়েছিলেন। আমার মনে হয়, কলকাতা শহরের প্রাচীন সীমানাগুলো, মানসিক এবং ঐতিহাসিক, ভেঙে পড়ায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তাতে উদ্বেগ, ত্রাস, এসে এমনকী, পাপগ্রস্ত মানুষের মুখচ্ছবিও পাল্টে দিচ্ছে।
থিয়েটার রোড কোনও ব্যক্তিগত মানুষের বিকার নয়, হিচককের মাতৃকামী যুবকটির মতোই একটি সভ্যতার পদস্খলন। ‘সাইকো’-য় যদি শুধুমাত্র এক মনোবিকারগ্রস্ত যুবকের আখ্যান থাকত, অথবা ব্যক্তির যৌন অবদমনের নিশানা খুঁজে পাওয়ার জন্য হিচকক ক্যামেরা ধরতেন, তা হলে ছবিটি শুরুই হত না। একটা শহরের প্যানোরামিক শট দিয়ে প্রথম শহরের নাম দেখতে পাই, তার পরে সময়চিহ্ন ও তারিখ দেখা যায়। তার পরে ক্যামেরা বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে, অ্যাপার্টমেন্টের উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যেন সে জীবন্ত মানুষ, সে ঠিক করতে পারে না, সামান্য দ্বিধায় পড়ে ধীরে একটি খোলা জানলা দিয়ে আধো অন্ধকারে ঢাকা এক ঘরে ঢুকে পড়ে। আসলে হিচকক যুদ্ধোত্তর আমেরিকায় নব আবিষ্কৃত ফ্রয়েড, আর্থিক বিপর্যয়, হলোকস্ট অথবা যৌন আচরণের উপর কিনসি রিপোর্টকে সঙ্গে নিয়ে, মহৎ শিল্পী বলেই, চেনা থেকে অচেনার পথে পাড়ি দেন। সাইকো পুঁজিবাদী দুনিয়ার যে কোনও এলাকার জবানবন্দি হতে পারত। ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর গবেষণা শুরু করেছিলেন শুধু ব্যক্তির পতনকে উপলক্ষ্য করে নয়, বরং সমাজ ও ব্যক্তির অবস্থানচ্যুতিকে লক্ষ্য করে।
আজকের রবিনসন স্ট্রিটে যে কঙ্কালের অট্টহাসি শুনতে পেলাম তা কোনও অবস্থাতেই সত্যজিৎ রায়ের ‘মণিমালিকা’র নয়। এ কবরখানার রতিমুদ্রা!
এই সংক্রান্ত আরও:
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy