Advertisement
১১ মে ২০২৪
বালিগঞ্জ প্লেস

ভয় ধরাচ্ছে বাইক-বাহিনীর ছিনতাই

আমার বাড়ি আর পাড়াকে কখনও আলাদা করে দেখতে শিখিনি। বালিগঞ্জ প্লেসের নির্ঝঞ্ঝাট পাড়া তখন ছিল এখনকার থেকে শান্ত। বর‌ং আমার বাড়িই তখন জমজমাট। বাবা-কাকাদের পরিবার মিলিয়ে জনা চল্লিশেক লোক। বাড়িটাই যেন আস্ত একটা পাড়া! ছোটবেলায়

অভিরূপ গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৩৭
Share: Save:

আমার বাড়ি আর পাড়াকে কখনও আলাদা করে দেখতে শিখিনি। বালিগঞ্জ প্লেসের নির্ঝঞ্ঝাট পাড়া তখন ছিল এখনকার থেকে শান্ত। বর‌ং আমার বাড়িই তখন জমজমাট। বাবা-কাকাদের পরিবার মিলিয়ে জনা চল্লিশেক লোক। বাড়িটাই যেন আস্ত একটা পাড়া! ছোটবেলায়

পাড়ায় গ্যাসল্যাম্পের আলো জ্বললেই সোজা ঢুকতাম বাড়িতে। বাবার কড়া নির্দেশ!

পাড়ায় দারুণ ক্রিকেট খেলা চলছে। হঠাৎ একটা বড়সড় গাড়ি এসে খেলার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখলাম, সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই গাড়িকে রাস্তা করে দিল। ব্যাপারটা বুঝতে উঁকি মারলাম ড্রাইভারের সিটে।
ওরে বাবা! এ তো যে সে ড্রাইভার নয়, ডাকসাইটে এক সুন্দরী মহিলা। বেশ বিরক্ত মুখ নিয়ে হর্ন বাজিয়ে রাস্তা ফাঁকা করতে বলছেন। নাম মুনমুন সেন। যাচ্ছেন তাঁর দাদু আদিনাথ সেনের বাড়ি। সুচিত্রা সেনকে না দেখলেও তাঁর স্বামী দিবানাথ সেনকে বহুবার দেখেছি আমাদের পাড়ায়। আমাদের বাড়ির ঠিক চারটে বাড়ি পরেই ছিল সুচিত্রা সেনের শ্বশুরবাড়ি। প্রাসাদোপম সেই বাড়ি তার গোলাপবাগান, বাঁধানো পুকুরঘাট নিয়ে পাড়ার শোভা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আসলে আমাদের পাড়া ছিল নক্ষত্রখচিত। বিকাশ রায়, সুবিনয় রায়, মায়া সেন, কত নাম যে বলব...

একটু একটু করে বদলে গেল পাড়ার এই ঘরোয়া চেহারা। আমাদের বাড়িতে এখন মাত্র সাত জন লোক। ওদিকে বাড়ির বাইরে, পাড়ায় লোক যেন আর ধরে না। চপ-কাটলেট-মিষ্টির ‘মুখার্জী সুইট্স’ আর ‘বেকড অ্যান্ড ফ্রাইয়ে’র দোকান নিয়ে
বেশ আনন্দে ছিলাম আমরা। ও মা! ফস ফস করে গজিয়ে উঠল ছ’ ছ’টা নামী রেস্তোরাঁ। তাদের চাহিদা এখন তুঙ্গে। পাড়ায় সারাক্ষণ খাদ্যরসিক মানুষের গাড়ি আর ভিড়। তবে শুধুমাত্র রেস্তোরাঁতেই নিস্তার নেই। এ পাড়া ঘিরে রেখেছে সাউথ পয়েন্ট, পাঠভবন, অক্সফোর্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এগারোটা বাজল কি শুরু হল শোরগোল-যানজট। মাঝে মাঝে ভয় করে শরীর খারাপ হলে ওই সময়ে ঠিক হাসপাতালে পৌঁছতে পারব তো! অ্যাম্বুল্যান্স বাড়িতে আসতে পারবে তো? তবে ইদানীং স্কুলের সময়ে খুব ভাল ভাবে যান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। আগে থেকেই পুলিশ চলে আসে এবং সুষ্ঠু ভাবে দায়িত্ব পালন করে। খানিক নিশ্চিন্ত হই।

তবে পাড়াটা এখন বুড়োদের। ছেলেমেয়েরা বড় হতেই কেউ হায়দরাবাদ, কেউ বেঙ্গালুরু, কেউ বা সোজা বিদেশ। অবাঙালির ভিড় বাড়ছে একটু একটু করে। সে তো আসবেই। কিন্তু আগের চেয়ে অনেক ঝকঝকে হয়েছে আমার পাড়া। ভোরের আলো ঢুকতেই হাজির হয় ঝাড়ুদারের দল। আবার দুপুরের ঘুম কাটিয়েই বিকেলের রাস্তায় চলে সাফাই অভিযান। মনে পড়ে যায় আমার ছেলেবেলার দাড়িওয়ালা সেই লোকটির কথা। কী যেন তাঁর নাম... ছেলেবেলায় ওকে দেখেই বুঝতাম বিকেল হয়েছে। হোসপাইপ দিয়ে গঙ্গার জল এনে তিনি ধুয়ে দিতেন সারা পাড়া। লোকে বলে, বালিগঞ্জ প্লেসের বাসিন্দারা আর যাই হোক আকাশে মেঘ দেখলে বৃষ্টি নিয়ে রোম্যান্স করার সাহস পাবেন না। এক পশলা বৃষ্টিতে আমাদের পাড়ায় এক হাঁটু জল। ৭৮, ৮৪, ৯৯’এর বন্যায় যে ভাবে বাড়িতে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো জল ঢুকেছিল, সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে আমার পাড়া। সুইনহো স্ট্রিট পর্যন্ত জল দাঁড়ালেও আমাদের পাড়ায় এখন তেমন আর জল জমে না।

ইদানীং একটা ভয় পাড়ার মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলছে। ভর সন্ধ্যা হোক বা সকাল, বাইকবাজ ছিনতাইকারীর উপদ্রব ঘটেছে। সেই দলে কয়েক জন ছেলে রয়েছে। তাদের পাকড়াও করাও মুশকিল। বলা

যায় না কখন তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে পড়ে ছোরা বা ভোজালি। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, সন্ধ্যার পরে বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের পাড়ায় একা ছাড়ার সাহসও পাচ্ছেন না।

এই বর্ণময় পাড়াকে এক খুঁটিতে বেঁধে রেখেছে ‘দুর্গা বাড়ি’র পুজো। ছাতিমের গন্ধে চারিদিকে বেশ এখন একটা পুজো পুজো ভাব। পুজো নিয়ে মেতে ওঠার কিন্তু কোনও বদল হয়নি। আগের মতোই শুরু হয়ে গিয়েছে নাটকের রিহার্সাল। পুজোর চারটে দিন আমাদের পাড়া ঘুমোয় না। ছেলেমেয়েরা যে যেখানেই থাক পুজোয় সবাই পাড়ায়। আসলে পাড়া তো নয়, যেন বাড়ির পুজো। একসঙ্গে সকলে ভোগ খাবে। প্রতিমা বিসর্জনের পরে গঙ্গাজল গায়ে ছিটিয়ে তবেই সবাই বিজয়ার প্রণাম নেবেন। কিছুই বদলায়নি। আবেগের কি আর বদল হয়! আজও গণেশ পুজোর প্যান্ডেলে পাড়ার বুড়োদের অস্বস্তির কথা ভেবে পাড়ার ছেলেরা লাউডস্পিকারে গান বাজানো বন্ধ করে রাখে।

খুব ছোট করেই বলতে ইচ্ছে করে এ পাড়াই আমার জন্মভূমি। এর কাছেই যেন নিজেকে ফুরিয়ে দিতে পারি।

লেখক বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE