Advertisement
১০ মে ২০২৪

রাজপথে ঘোড়ার গাড়ি কি আর দেখা যাবে না

বম্বে হাইকোর্টের নির্দেশে এক বছরের মধ্যেই মুম্বইতে নিষিদ্ধ হতে চলেছে ঘোড়ার গাড়ি। কলকাতাতেও কী তা হলে এই গাড়ি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে? স্মৃতিমেদুরতায় ঘোড়াগাড়ির উপর আলোকপাত করলেন অশোক সেনগুপ্ত।বম্বে হাইকোর্টের নির্দেশে এক বছরের মধ্যেই মুম্বইতে নিষিদ্ধ হতে চলেছে ঘোড়ার গাড়ি। কলকাতাতেও কী তা হলে এই গাড়ি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে? স্মৃতিমেদুরতায় ঘোড়াগাড়ির উপর আলোকপাত করলেন অশোক সেনগুপ্ত।

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনের রাজপথ। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার গাড়ি। বিকেলের নরম আলোয় তারই যে কোনও একটায় চড়ে ময়দানের একটা অংশ ঘুরে ফেলা যায়। অবশ্যই দরদাম করে। গাড়ির জৌলুসের সঙ্গে ঘোড়ার চেহারায় বিস্তর ফারাক থাকলেও পর্যটকের ঘোরায় তা কোনও ভাবেই প্রভাব ফেলে না। তবে, শহরের রাজপথে ঘোড়াগাড়ির দৌড়াদৌড়ি ইদানীং অনেকটাই কমে এসেছে। আগের সেই রমরমা আর নেই। রমরমার সেই দিনের কথা রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে কবেই লিখেছিলেন, ‘‘আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়ছড় করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের-করা ঘোড়ার পিঠে।’’

কলকাতায় বাবু কালচার আর নেই। তার সঙ্গে অদৃশ্য হয়েছে অনেক কিছু। একসময় বাবুরা বিদেশ থেকে ল্যান্ডো, ফিটন, ব্রাউন বেবি, ব্যারুস আনাতেন। সেগুলো টানত ওয়েলার আর আর্বি ঘোড়া। সম্পন্ন বাবুরা অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এ কারণে আনাতেন তেজি ঘোড়া। আজ এ সব ইতিহাস!

উনিশ শতকের মাঝ পর্বে এ শহরে বেশ কিছু বনেদি বাড়িতে ঘোড়ার গাড়ি এসে গিয়েছিল। ক্রমে সেই গাড়ি হয়ে ওঠে ধনী সম্প্রদায়ের প্যাশন। যাত্রী পরিবহণও শুরু হল। চালক ঘোড়াদের জলপানের জন্য তৎকালীন পুরসভা রাস্তার ধারে চৌবাচ্চার মতো ধাতব পাত্র তৈরি করে দিয়েছিল। খুঁজলে এখনও সে রকম কিছু নমুনা মিলবে রাজাবাজার এলাকায়। কারণ, কোচোয়ান, ঘোড়ার আস্তাবল— এ সব ওই তল্লাটেই বেশি ছিল। ১৮৫৬ নাগাদ ঘোড়ার গাড়ি গেল ঢাকায়। সেখানকার শাঁখারিটোলার ‘সিরকো অ্যন্ড সন্স’ যাত্রী বহনের উদ্দেশে এই গাড়ি এনেছিল।

রিকশা এবং যন্ত্রচালিত গাড়ি আসার আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ঘোড়ার গাড়ি ছিল আমাদের ল্যান্ডমার্ক। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, ‘‘গাড়োয়ানেরা পুলিশকে যথারীতি নজর সেলামী দিবার ফলে নির্ভয়ে কোচ-বাক্সে ও গাড়ির ছাদে নির্দিষ্ট সংখ্যা অপেক্ষা অনেক বেশী আরোহী উঠাইত। অনেক সময় পক্ষীরাজ ঘোড়া দুইটি গাড়ি টানিতে না পারিয়া পথিমধ্যে দাঁড়াইয়া যাইত।’’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটদের জন্য তাঁর একটি লেখায় কোচোয়ানদের পোশাক-পাগড়ি-কোচবাক্সে বসা— এ সব নিয়ে সুন্দর ছবি এঁকেছিলেন। সব মিলিয়ে যেন একটা সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্য!

আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে ঐতিহ্যের এই গাড়ি। যেগুলো টিকে থাকে, সেগুলোর মালিক-কোচোয়ানদের মূল কাজ হয়ে ওঠে বিয়ের অনুষ্ঠান-নাটক-সিনেমা আর ময়দানের হাওয়া খাওয়ানোর মাধ্যমে কিছু আয় করা। কয়েক দশক আগেও পর্দায় বা সেলুলয়েডে মাঝে মাঝেই আমাদের স্মৃতিমেদুরতাকে উস্কে দিয়েছে ঘোড়ার গাড়ি। যেমন, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ নিয়ে টেলি-ফিচার করে কলকাতা দূরদর্শন।

সম্প্রতি ‘অ্যানিমেল অ্যান্ড বার্ডস চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর তরফে একটি জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে মুম্বই হাইকোর্টের দুই বিচারপতি এএস ওকা এবং একে মেনন প্রাণী-নির্যাতন নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘোড়ার গাড়িকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে স্থানীয় পুরসভাকে এক বছরের মধ্যে এই গাড়ি বন্ধ করার নির্দেশও দেন। এ সব গাড়ির সঙ্গে জড়িত প্রায় ৭০০ জনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আদালত দিয়েছে মহারাষ্ট্র সরকারের হাতে। এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কলকাতাও কি সেই পথ ধরবে?

তবে আইনের কড়া চোখ ঘোড়ারগাড়ির উপর এ শহরে অনেক দিন আগেই পড়েছে। এক গাড়ির এক মালিক প্রবাল মুখোপাধ্যায় পুরসভার লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও কলকাতা পুলিশের লাইসেন্স পেলেন না। ২০১২-র শেষ ভাগে এ কারণে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালতে পুলিশ বলল, এই গাড়ি পুরনো। এ রকম গাড়ির বিরুদ্ধে শহর নোংরা করা ও যানজটের যুক্তিও তারা পেশ করে। সব শুনে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত জানালেন, ঘোড়ার গাড়িকে কেবল পুরনো যান বলে দেখলে চলবে না। এর সঙ্গে কলকাতা শহরের ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। প্রশাসন এই গাড়িকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু, পুরো তুলে দেওয়া উচিত হবে না।

এ শহরে ঘোড়ার গাড়ি সীমাবদ্ধ কেবল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে। সেখানকার এক কোচোয়ান সেলিম আলির তিন পুরুষের রুজি ঘোড়ার গাড়ি। নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নে অবাক হয়ে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘তা হলে আমরা কী করব?’’ বললেন, ‘‘শুনেছি মুম্বই ও করাচির সমুদ্রসৈকতে লোকে উট চড়ে। পর্যটনের দৃষ্টিভঙ্গিতে তা হলে এখানেও তো ঘোড়ার গাড়ি থাকতে পারে!’’

আবেগমথিত এই মন্তব্যতে সায় দিয়েছেন ‘কম্পেশনেট ক্রুশেডর ট্রাস্ট’-এর দেবাশিস চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য, মুম্বইয়ের ঘোড়াগুলো ‘অনিয়ন্ত্রিত’। কলকাতার এই সব প্রতিটি ঘোড়ার বিশদ ঠিকুজি-কুষ্টি আছে। বেওয়ারিশ কোনও ঘোড়া এ শহরে গাড়ি টানে না। এগুলো সবই রেসের বা সেনা ও পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ঘোড়া। পর্যটকদের নিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পাক খেয়ে ওরা নিজেদের এবং কিছু পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার রসদ সংগ্রহ করে মাত্র। আর পশুক্লেশের প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘যে কোনও ঘোড়ার রক্তসঞ্চালনের জন্য মালিশ প্রয়োজন। এই মালিশ করতে গেলে যে খরচ দরকার, পর্যটক-গাড়ি না টানলে সে খরচ সহিস বা ঘোড়ামালিক পাবেন কোথা থেকে?’’

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE