Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পীরা শেষ করতেই শুরু ওঁদের রাত জাগার পালা

পঞ্চমীর সকালেই খুঁটিয়ে মণ্ডপ পরীক্ষা করছিলেন নিতাই পারিয়া। একটু রংচটা দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালেন সহকারীদের। কয়েক ঘণ্টায় ফের মণ্ডপ ‘সারিয়ে’ তুললেন তাঁরা!

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৫৬
Share: Save:

পঞ্চমীর সকালেই খুঁটিয়ে মণ্ডপ পরীক্ষা করছিলেন নিতাই পারিয়া। একটু রংচটা দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালেন সহকারীদের। কয়েক ঘণ্টায় ফের মণ্ডপ ‘সারিয়ে’ তুললেন তাঁরা!

চতুর্থীতে কাঁকুড়গাছি যুবকবৃন্দের প্রতিমার শাড়ির পাড় দেখে খুঁতখুঁত করছিলেন শিল্পী অনির্বাণ দাস। ‘ফিনিশিং টাচ’ দিতে ডাক পড়ে আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র উষ্ণীষ মুখোপাধ্যায়ের। তুলির টানে নিখুঁত পাড় ফুটে উঠতেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন অনির্বাণ।

মণ্ডপে কাজ শেষ। স্বস্তিতে শিল্পীরাও। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না পুজোকর্তারা। ভিড়ের দাপটে কোথায় মণ্ডপের রং চটছে, মালা পরাতে গিয়ে প্রতিমার ক্ষতি হল কি না, এ সব নিয়ে বিসর্জনের আগে পর্যন্ত চিন্তা কাটে না তাঁদের। তাই পুজো শুরু হয়ে গেলেও কাজ শেষ হয় না নিতাই-উষ্ণীষ-প্রশান্তদের।

পুজোর চার মাস আগে থাকতেই পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির বাড়ি ছেড়ে সদলবলে কলকাতায় চলে আসেন নিতাই। সুরুচি, শিকদারবাগান, অজেয় সংহতির মতো অন্তত পাঁচটি ক্লাবের কারুকাজ রক্ষার দায় তাঁর দলের। পুজোর আগে তো কারিগর হিসেবে কাজ থাকেই, পুজো শুরু হলেও কাজ ফুরোয় না। সকাল-সন্ধ্যা মণ্ডপ খুঁটিয়ে দেখে ত্রুটি ধরা পড়লেই সারিয়ে তুলতে হয়।

প্রতিমার ক্ষেত্রে এমন কাজ থাকে উষ্ণীষদের। শহরের নামী প্রতিমা শিল্পী নব পালের সহকারী হিসেবে কাজ করেন তাঁরা। সহায়তা করেন বিভিন্ন শিল্পীদেরও। প্রতিমা রং হওয়ার পরে শাড়ির পাড়, চালচিত্রের খুঁটিনাটি কাজ করতে হয় উষ্ণীষদেরই। তা ছাড়া মণ্ডপের আলপনা, দেওয়ালের কাজও করতে হয়। উষ্ণীষ বলছেন, “অনেক সময়েই শেষ বেলায় প্রতিমার সামান্য কিছু সাজ বদলাতে হয়। মণ্ডপের ক্ষতি সারাই করতে হয়। পুজো শুরুর পরে ডাক পড়া অস্বাভাবিক নয়।” এ বার সুরুচির বেশ কিছু খুঁটিনাটি কাজ করেছেন প্রশান্ত সেনও। কিছু কিছু টাচ দিতে তাঁরও শেষ বেলায় ডাক পড়েছে।

সন্তোষপুর লেকপল্লির মণ্ডপে এ বার পুরীর সৈকতের বালিশিল্প তুলে ধরছেন শিল্লী সঞ্জীব দাস। সেই কাজ করতে নিয়ে এসেছেন দুই শিল্পীকে। কিন্তু বালির এই সূক্ষ্ম কাজ এত লোকের হুড়োহুড়িতে নষ্ট হবে না? হাওয়ার দাপটেও তো বালি সরে যাবে! লেকপল্লির পুজোকর্তারা সেই কারণেই দুই শিল্পীকে পুজোর চার দিন রেখে দেবেন শহরেই। প্রতি দিনই বালি শিল্পের মেরামতি হবে।

প্রতিমা বা মণ্ডপের জন্য তো বড় ক্লাবগুলি কারিগর-শিল্পীদের রেখে দেয়। কিন্তু শহরের নামী-অনামী সব পুজোতেই চার দিন কার্যত যুদ্ধ-পরিস্থিতি সামলাতে হয় আলোর শিল্পী-কারিগরদের। ক’বছর ধরেই পুজোর থিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আলোর কারিকুরি। ব্যবহার হচ্ছে অভিনব সব বাতিরও। এই সামলাতে চার দিন, ২৪ ঘণ্টাই পালা করে ডিউটি করতে হয় আলোর কারিগরদের। কখনও কখনও পঞ্চমীর রাতে আলোর সাজ বদলানোর ঘটনাও এ শহরে বিরল নয়।

শহরের বিভিন্ন মণ্ডপে এমন ভাবেই দলবল নিয়ে রাত জাগেন হাতিবাগানের বাসিন্দা দিলীপ মুদি। ছোটখাটো বিভ্রাট হলেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ শুরু করেন। প্রতিমা মণ্ডপ ছেড়ে রওনা হওয়ার পরেই ছুটি পান দিলীপবাবুরা।

পুজোকর্তাদের অনেকেই বলছেন, আনন্দের সময়ে মণ্ডপে থাকা এই লোকগুলিকে দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। উৎসবের সময়ে পরিবার ছেড়ে দূরে থাকা কতটা কষ্টের, তা বলছিলেন নিতাই পারিয়াও। বাড়িতে স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে আছে। চার দিন বাড়ির লোকটার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন তাঁরাও। দশমীতে যখন মণ্ডপ জুড়ে বিষাদ, তখন ঘরের মানুষ ঘরে ফেরার আনন্দে ভরে ওঠে নিতাইবাবুদের বাড়ি। বাড়ির কাছে থেকেও পুজোয় পরিবারকে সময় দিতে পারেন না দিলীপবাবুরা।

একাদশী থেকে পুজোর কাজ শুরু করেন, এমন লোকও আছেন। যেমন সুরুচি সঙ্ঘের রাজা সরকার, অজেয় সংহতির হিল্লোল বসু বা আহিরীটোলার দুলাল সিংহ। পুজো ফুরোতেই লেগে পড়েন পরের বছরের প্রস্তুতিতে। কী থিম হবে, কী ভাবে হবেতা নিয়েই কেটে যায় তাঁদের দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE