Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সকালের অসীম আশা ফিকে হল বিকেলেই

নিজে এগিয়ে শাসক দলের প্রার্থী, প্রতিপক্ষ সুধীরকুমার সাহার সঙ্গে খাঁটি ‘স্পোর্টসম্যান্‌স স্পিরিটে’ হাত মিলিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরে যা ঘটল, একদা প্রেসিডেন্সি কলেজ টিমের ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান অসীম দাশগুপ্ত তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ডবল ই ব্লকের কমিউনিটি হলের বুথের সামনে তৃণমূল প্রার্থীর ঠিক পাশ থেকেই হাতে নীল-সাদা রুমাল নাচিয়ে সানগ্লাসধারী পেটমোটা যুবক অভব্য কটূক্তি ছুড়ে দিলেন।

দলীয় সমর্থকদের অভিযোগ শুনছেন অসীম দাশগুপ্ত। শনিবার, সল্টলেকে। ছবি: দেবাশিস রায়

দলীয় সমর্থকদের অভিযোগ শুনছেন অসীম দাশগুপ্ত। শনিবার, সল্টলেকে। ছবি: দেবাশিস রায়

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০১:০৪
Share: Save:

নিজে এগিয়ে শাসক দলের প্রার্থী, প্রতিপক্ষ সুধীরকুমার সাহার সঙ্গে খাঁটি ‘স্পোর্টসম্যান্‌স স্পিরিটে’ হাত মিলিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরে যা ঘটল, একদা প্রেসিডেন্সি কলেজ টিমের ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান অসীম দাশগুপ্ত তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
ডবল ই ব্লকের কমিউনিটি হলের বুথের সামনে তৃণমূল প্রার্থীর ঠিক পাশ থেকেই হাতে নীল-সাদা রুমাল নাচিয়ে সানগ্লাসধারী পেটমোটা যুবক অভব্য কটূক্তি ছুড়ে দিলেন। শুনে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলেন বাম-শিবিরের হেভিওয়েট মেয়র পদপ্রার্থী! ‘‘কে আপনি, কোথা থেকে সল্টলেকে এসেছেন!’’ পরে আক্ষেপের সুরে বর্ষীয়ান রাজনীতিক বললেন, ‘‘নাহ্‌, সল্টলেকের ভোটের পাড়া পাড়া মেজাজের সঙ্গে বহিরাগতদের এই অসভ্যতা খাপ খায় না।’’
রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর চিৎকারে পুলিশ খানিকটা গা-ঝাড়া দিল, এই যা! বিধাননগর (পূর্ব) থানার আই সি শেখর রায় ‘স্যার, স্যার’ বলে ছুটে এলেন। ‘বহিরাগতেরা’ টপাটপ বুথের পাশে বাঁশের বেড়া টপকে মুখ ঢেকে ছুট লাগাল। পুলিশ ক’জনকে পাকড়াও-ও করল। কিন্তু অসীমবাবু অন্য বুথে পা বাড়াতেই পুরনো জায়গা থেকে ‘স্যার, ওরা আবার এসেছে’ বলে কমরেডদের কাছ থেকে ফের এসওএস-বার্তা ছুটে এল। হতাশ অসীমবাবু এক সময়ে বলে ফেললেন, ‘‘এ তো লুকোচুরি খেলা হচ্ছে।’’
ডবল ই ব্লকের বিভিন্ন বুথ, রবীন্দ্র ভবন থেকে করুণাময়ী আবাসন লাগোয়া আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ভবন, ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড থেকে অরবিন্দ স্কুলের বুথ— শনিবার সকাল থেকে দুপুর, তবু বারবার টো টো করলেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী। পরনে সেই ট্রেডমার্ক সাদা ফুলশার্ট, প্যান্ট, চকচকে বুটজুতো। মেজাজটাও অবিকল আগের মতো। অরবিন্দ ইনস্টিটিউটের ভোটকেন্দ্রে ঢোকার আগে পুলিশকে বললেন, ‘‘আমরা কিন্তু দেখছি, কে কোথায় ডিউটি করছেন! ভোটার কার্ডের মুখ মিলিয়েই লোক ঢোকাবেন।’’ ডেয়ারি বোর্ডের সশস্ত্র কনস্টেবলকে বুথের কোথায় দাঁড়াতে হবে বুঝিয়ে অভয় দিলেন, ‘‘আপনি কিন্তু সামান্য লোক নন। কেউ ফল্‌স ভোট দিতে গেলে তাকে গ্রেফতার করতে পারেন।’’ প্রিসাইডিং অফিসারদেরও দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। ভোটারদের লাইনে সন্দেহভাজন অবয়ব দেখে ‘‘কে ভাই, কোথা থেকে এসেছেন’’ বলে কখনও চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন। করুণাময়ী আবাসনে হাঁটতে হাঁটতে কখনও বা বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারকে ‘‘আমার সামনে-পিছনে বহিরাগতেরা হাঁটছে’’ বলে ফোনে অভিযোগ জানালেন।
এপিসি ভবনে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র দিদি অণিমা চৌহান লাঠি ঠুকঠুকিয়ে কষ্ট করে ভোট দিতে এসেছেন দেখে এক মুহূর্ত অসীমবাবুর দু’চোখ উজ্জ্বল হয়েছিল! পরক্ষণেই তাঁর নিজের এজেন্ট অমিত গোস্বামী ‘স্যার’কে দেখালেন কী ভাবে বহিরাগতেরা মেরে বুথ থেকে বার করে দিয়েছে। অভিযোগ সব বুথেই। ডেয়ারি বোর্ডে ৩২৯ নম্বর বুথের প্রিসাইডিং অফিসার বললেন, ‘‘স্যার, কী করব? দু’জন এই মাত্র জোর করে ভোট দিয়ে পালাল!’’ রবীন্দ্র ভবনের বুথে বেলা ১২টা নাগাদ জনৈক বাম এজেন্টের স্বামী, ‘‘স্যার, আর ‘রেজিস্ট’ করা যাচ্ছে না!’’ বলে কাতর ভঙ্গিতে আত্মসমর্পণ করলেন। দলের কমরেড বিশ্বজিৎ মাইতি, সুমিতা সাহা থেকে বিজেপি প্রার্থী মনোজ দাসও ‘ওরা চশমা ভেঙে দিয়েছে’ বা ‘ঘাড়ধাক্কা দিয়েছে’ বলে তাঁর শরণাপন্ন হলেন। অরবিন্দ স্কুল থেকে খবর এল, প্রৌঢ়া কমরেড শাশ্বতী মণ্ডল মার খেয়েছেন, এজেন্ট শাক্য মাইতিকে বুথ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে। কয়েক দশকের ভোটযুদ্ধের সৈনিক অসীমবাবু এক ফাঁকে বললেন, ‘‘লোকাল ভোটে তো আগে লড়িনি! এখানে সব কিছুই নিজেকে সামলাতে হচ্ছে।’’

প্রতিপক্ষের কটুকাটব্যও সমানে সইতে হয়েছে বিরোধী শিবিরের ক্যাপ্টেনকে। বহিরাগতদের দাপট নিয়ে অভিযোগ তোলায় রবীন্দ্র ভবনে তৃণমূল কর্মীরা এ সবই ‘সুভাষ চক্রবর্তীর ট্যাকটিক্স’ বলে খোঁচা দিলেন। এপিসি ভবনের তৃণমূল এজেন্ট শুভাঞ্জন দত্ত অসীমবাবুর সামনেই বাম এজেন্টকে ‘‘আপনাকে কিন্তু পাড়ায় থাকতে হবে’’ বলে হুমকি দিলেন। অরবিন্দ স্কুলের দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে চত্বর দাপানো তৃণমূল কর্মীদের ঠাট্টা, ‘বিধানসভা, লোকসভা, কর্পোরেশনের পরে কি পঞ্চায়েতেও দাঁড়িয়ে হারবেন স্যার?’ ওই স্কুলের ঠিক বাইরে হঠাৎ তৃণমূলের সাবেক পুরসভাপতি কৃষ্ণা চক্রবর্তীর মুখোমুখি। অসীমবাবু বহিরাগতদের নিয়ে কথা বলছেন শুনে কিছুটা ভাববাচ্যে কৃষ্ণার ঠেস, ‘‘মানুষের ভোটই হল সব!’’

মিডিয়া অসীমবাবুর সঙ্গে ছুটছে বলে ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী সুধীরবাবুও তাঁকে কটাক্ষ করছিলেন। রবীন্দ্র ভবনের সামনে অসীমবাবু যেচে তাঁর সঙ্গে ভাব করতে তিনি গলে জল। সুধীরবাবু বললেন, ‘‘আপনার নেতৃত্বেই বিধাননগর বাঁচাও আন্দোলনে লড়েছি!’’ অসীমবাবু তাঁকে এক ধারে ডেকে বললেন, ‘‘আপনার বহিরাগতদের প্লিজ সামলান!’’ ‘‘সে তো দু’এক জন কালচারাল ফাংশন দেখতেও পাড়ায় আসে’’— বলে এড়িয়ে গেলেন সুধীরবাবু। কিছু ক্ষণের মধ্যে ডবল ই ব্লকেই তৃণমূল প্রার্থীর সামনে ফের অসীমবাবু ও তাঁর সঙ্গীরা ‘বহিরাগতদের’ দেখে সরব হলেন।

সকাল সাড়ে সাতটা থেকে শুরু করে বেলা দেড়টা পর্যন্ত মাঠে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিলেন ক্যাপ্টেন। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ সামান্য ডাল-ভাতের বিরতি। ‘‘বহিরাগতদের উৎপাতের মুখেও মানুষ কিন্তু জেদের সঙ্গে ভোট দিতে বেরিয়েছে’’— বারবার বলছিলেন তিনি। এর পরে করুণাময়ীতে এক কমরেডের বাড়িতে কিছু ক্ষণ ফোনে শলা-পরামর্শ! যখন বেরোলেন, তখন বেশির ভাগ বুথেই বাম এজেন্ট গায়েব। তিনটে নাগাদ এফ ই ব্লকের বাড়িতে ঢোকার আগে অসীমবাবু বললেন, ‘‘ভোট নয়, সব মিলিয়ে কিন্তু পুরো প্রহসন হয়েছে!’’

আর যা-ই হোক, খেলাটা নির্ভেজাল ক্রিকেট হয়নি, তত ক্ষণে বুঝে নিয়েছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE