Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সকালের মেঘ কেটে সূর্য হাসতেই জমে গেল বোধন

দুপুরের এক পশলা প্রবল বৃষ্টি মানুষের রোখটা বোধহয় দ্বিগুণ করে দিল। মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম পুরোপুরি স্থবির হয়ে গেল মহানগরী। পাঁজি মেনে শুরুর দিনেই জমজমাট ‘উৎসব কাপ’। ঘনঘন বাজ, হাওয়া, তার সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি বোধনের দুপুরে পুজো কমিটিগুলির অনেককেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। জলও জমে গিয়েছিল পূর্ব কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপের সামনে। কিন্তু বৃষ্টি কমতেই চনমনে রোদ।

আজ মহাসপ্তমী: মঙ্গলবার বাগবাজার সর্বজনীনে সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

আজ মহাসপ্তমী: মঙ্গলবার বাগবাজার সর্বজনীনে সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৪১
Share: Save:

দুপুরের এক পশলা প্রবল বৃষ্টি মানুষের রোখটা বোধহয় দ্বিগুণ করে দিল। মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম পুরোপুরি স্থবির হয়ে গেল মহানগরী।

পাঁজি মেনে শুরুর দিনেই জমজমাট ‘উৎসব কাপ’। ঘনঘন বাজ, হাওয়া, তার সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি বোধনের দুপুরে পুজো কমিটিগুলির অনেককেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। জলও জমে গিয়েছিল পূর্ব কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপের সামনে। কিন্তু বৃষ্টি কমতেই চনমনে রোদ। আর দোকানে, গাড়িবারান্দায়, বহুতলের গ্যারাজে আশ্রয় নেওয়া কালো মাথাগুলি বেরিয়ে পড়ল হুড়মুড় করে। বেলা যত বেড়েছে, ততই কেটে গিয়েছে হতাশার মেঘ। আর সন্ধ্যায় পুজো কমিটির ব্যাজ পরা স্বেচ্ছাসেবকেরা পুলিশের সঙ্গে রাস্তায় নেমেও গতি আনতে পারেননি রাস্তায়।

লালবাজারের ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যস্ত। ফোন পাওয়াই যাচ্ছে না। রাস্তার ধারে কিয়স্ক থেকে এক পুলিশ অফিসারের প্রায় আর্তনাদের মতো কথা শোনা যাচ্ছিল, “চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে শোভাবাজারের দিকে গাড়ি প্রায় এগোচ্ছেই না! বন্ধ অরবিন্দ সরণি। গড়িয়াহাট রোডে ঢাকুরিয়া ব্রিজের উপর আটকে গিয়েছে গাড়ি। দুর্গাপুর ব্রিজও বন্ধ। জেম্স লং সরণিও তথৈবচ। মন্দের ভাল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড।” কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রের অবশ্য দাবি, “ষষ্ঠীর সন্ধ্যা থেকেই ভিড় ও যান চলাচল আমাদের নিয়ন্ত্রণে। মানুষ নিশ্চিন্তেই ঘুরতে পারছেন।”

ভিড়ের শুরু অবশ্য বেলা দু’টোতেই। প্রতিটি স্টেশনে ভিড় উগরে দিয়েছে মেট্রো। শোভাবাজারে নামা জনস্রোতের একটা অংশ সোজা চলে গিয়েছে কুমোরটুলি পার্ক, শোভাবাজার বেনিয়াটোলা, ১৯ পল্লি, আহিরীটোলা যুববৃন্দ, আহিরীটোলা সর্বজনীনের দিকে। আহিরীটোলার বিশাল প্রতিমার দিকে তাকিয়ে এমনিতেই মানুষের মাথা নিচু হয়ে গিয়েছে। বেনিয়াটোলার গলির ভিতরে ধানের চারা দিয়ে অন্য রকম পরিবেশ তৈরি করেছেন ১৯ পল্লির পুজোকর্তারা।

বেলা যত গড়িয়েছে, পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে ভিড়ও। কালীঘাট, রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশন থেকে ভিড় চলে গিয়েছে এক দিকে গড়িয়াহাট, চেতলা, নিউ আলিপুরের দিকে। বিকেলেই বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘ, ৬৬ পল্লির সামনে লম্বা লাইন পড়েছে। সেই ভিড় চেতলা অগ্রণী হয়ে চলে গিয়েছে নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘের দিকে। যোধপুর পার্ক, ৯৫ পল্লি থেকে ভিড় বেরিয়ে চলে এসেছে সেলিমপুর, বাবুবাগান হয়ে হিন্দুস্থান পার্ক, একডালিয়ায়।

মেট্রোয় অনেকেই যান কুঁদঘাটের দিকে। সেখান থেকে হরিদেবপুরের বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিক, ৪১ পল্লি, বিবেকাননন্দ স্পোর্টিং হয়ে অজেয় সংহতিতে শেষ হয়েছে লাইন। এ বার বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিকে থ্রি-ডি চিত্রের কারিকুরি। বিদেশি শিল্পী ট্রেসি লি স্টামের কাজ দেখতে লোক জমেছে। কলাভবনের শিক্ষক কমলদীপ ধর এ বার ৪১ পল্লিতে।

অজেয় সংহতির মণ্ডপ এ বার সেজেছে মাটির প্রদীপে। রাত জমতেই পোড়ামাটির গায়ে আলোর খেলায় তাক লেগেছে অনেকের। কুঁদঘাট মেট্রোর পাশে পুটিয়ারি ক্লাবে এ বার তেলের টিন দিয়ে থিম গড়েছেন দেবনাথ রায়। সেখানেও লাইন। দেশ বিদেশের মুদ্রায় সেজে ওঠা পশ্চিম পুটিয়ারি পল্লি উন্নয়ন সমিতির মণ্ডপও দিব্যি লাগছিল ষষ্ঠীর সন্ধ্যায়।

প্রতি বছরের মতো ভিড় টানার লড়াইয়ে এ বারও ছুটছে বেহালা। বড়িশা ক্লাব, বেহালা ক্লাব, নূতন দলের পাশাপাশি ভিড় টানার লড়াইয়ে উঠে এসেছে ম্যান্টনের প্রগতি সঙ্ঘ, ঠাকুরপুকুর এসবি পার্ক। ঠাকুরপুকুরের ওই পুজোয় এক টুকরো রাজস্থানি শিল্প তুলে এনেছেন শিল্পী বিশ্বনাথ দে। তা দেখতেই ভিড় জমেছে সেখানে। প্রগতি সঙ্ঘের পুজোয় বাঁশ ও বেতের মণ্ডপ চোখ টেনেছে সবারই।

সন্ধ্যা গড়াতেই ভিড় বেড়েছে লোকাল ট্রেনে। বনগাঁ ও মেন লাইনের ট্রেনে চেপে মফস্সল ও জেলার লোকেরা শিয়ালদহ স্টেশনে নেমেছেন। সেখান থেকে একটি ভিড় চলে গিয়েছে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, কলেজ স্কোয়ার হয়ে মহম্মদ আলি পার্কের দিকে। পুলিশের হিসেবে, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মহম্মদ আলি পার্কের কাছে হাজার পাঁচেক লোক! কেউ কেউ ট্রেন ধরে বালিগঞ্জ, যাদবপুর স্টেশনে নেমেছেন। বালিগঞ্জ থেকে একটি ভিড় চলে গিয়েছে বোসপুকুর শীতলামন্দির, তালবাগান, রাজডাঙা নব উদয়ের দিকে। বছর দশেক আগে বোসপুকুর শীতলামন্দির ভাঁড়ের মণ্ডপ গড়ে তাক লাগিয়েছিল। এ বার বিস্কুট-ক্যান্ডির মণ্ডপ দেখতেও ভিড় উপচে পড়েছে।

শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছনোর আগে একটা বড়সড় ভিড় নেমে গিয়েছে বিধাননগর স্টেশনে। সেখান থেকে একটি ভিড় চলে গিয়েছে তেলেঙ্গাবাগান, করবাগান, শুঁড়িরবাগানের মতো ওই এলাকার সব ক’টি পুজোতেই। সেখান থেকেই ভিড় এগিয়ে গিয়েছে হাতিবাগানের পথে। নলিন সরকার স্ট্রিটে দর্পণের মণ্ডপ নজর কেড়েছে। সেই ভিড়ই পায়ে পায়ে এগিয়ে নবীনপল্লির লণ্ঠনের মণ্ডপ, হাতিবাগান সর্বজনীনের তালপাতার শিল্প দেখেছে।

কেউ কেউ শিকদারবাগানের মাশরুম শিল্প দেখে এগিয়ে গিয়েছে শ্যামপুকুর সর্বজনীনের দিকে। আর একটা ভিড় হাতিবাগান মোড় থেকে বিধান সরণি ধরে এগিয়ে কাশী বোস লেন, হরি ঘোষ স্ট্রিটের পুজো দেখে সিমলার দিকে এগিয়েছে। ভরসন্ধ্যায় কাশী বোস লেনের সামনে উপচে পড়া ভিড় দেখে উজ্জীবিত উদ্যোক্তারা।

ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় প্রতি বছরের মতো ভিড় টেনেছে বাগবাজার সর্বজনীন। সেখানে সন্ধ্যার আরতি দেখার জন্য মণ্ডপে ঠাসাঠাসি ভিড়! কেউ কেউ আবার থিমের পুজো দেখার পাশাপাশি শোভাবাজার রাজবাড়ি, দাঁ বাড়ি, হাটখোলার দত্তবাড়ির মতো সাবেক বাড়িগুলিতেও উঁকি দিয়েছেন।

টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের ভিড়ের একটা বড় অংশ টেনে নিয়েছে রানিকুঠির নেতাজি জাতীয় সেবাদল, নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ। ভিড়ের একটা অংশ টেনেছে যাদবপুর-সন্তোষপুরের ক্লাবগুলিও। গড়িয়াহাট থেকে যাদবপুর থানার মোড় হয়ে সুকান্ত সেতু পেরিয়ে গাড়ির লাইন গিয়েছে সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্ক, লেকপল্লি, অ্যাভিনিউ সাউথে। সন্তোষপুর লেকপল্লির থিম সমুদ্র। রংবেরঙের ঝিনুকের পাশে পুরীর বালি-ভাস্কর্য উপরি পাওনা সেখানে। অ্যাভিনিউ সাউথে পেরেক, শিশুদের দুধের বোতলের নিপল দিয়ে মণ্ডপ গড়েছেন রিন্টু দাস। পুজো ময়দানের নবীন শিল্পী রিন্টু দাস এ বারও ভিড় টানছেন।

উৎসব কাপের ভিড় টানার লড়াইয়ে কম যাচ্ছে না পূর্ব কলকাতাও। কাঁকুড়গাছির মিতালি, যুববৃন্দ, স্বপ্নারবাগান, বেলেঘাটা ৩৩ পল্লি হয়ে ভিড়ের একটা বড় অংশ চলে গিয়েছে এন্টালি পদ্মপুকুর ২০ পল্লির দিকে।

বোধনের দিনে ভিড়ের দড়ি টানাটানির খেলায় এগিয়ে থেকেছে সুরুচি সঙ্ঘ। তবে উৎসব কাপ কে জিতবে, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও দু’দিন। নবমীর রাতেই স্পষ্ট হবে, এই যুদ্ধে সেরা কে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pujo kuntak chattopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE