Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
বেনিয়াটোলা স্ট্রিট

হারিয়ে যাওয়া সেই আড্ডাটা আর ফিরল না

গায়ে গায়ে অসংখ্য সারিবদ্ধ নতুন পুরনো বাড়ি। কোনওটা উজ্জ্বল কোনওটা বিবর্ণ মলিন। তারই মাঝে কত পরিচিত মুখ, অতিপরিচিত পরিবেশ আর সেই চেনা গন্ধটা। পুরনো বাড়িগুলির দোতলার বারান্দায় সেকেলে কাঠের জানলার ফাঁক দিয়ে দিব্যি চলে আলো আঁধারির লুকোচুরি।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

প্রতাপচন্দ্র পাল
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৫০
Share: Save:

গায়ে গায়ে অসংখ্য সারিবদ্ধ নতুন পুরনো বাড়ি। কোনওটা উজ্জ্বল কোনওটা বিবর্ণ মলিন। তারই মাঝে কত পরিচিত মুখ, অতিপরিচিত পরিবেশ আর সেই চেনা গন্ধটা। পুরনো বাড়িগুলির দোতলার বারান্দায় সেকেলে কাঠের জানলার ফাঁক দিয়ে দিব্যি চলে আলো আঁধারির লুকোচুরি। এ সব নিয়েই আমার পাড়া বেনিয়াটোলা স্ট্রিট।

রবীন্দ্র সরণি এবং বিকে পাল অ্যাভিনিউ-এর সংযোগস্থল থেকে শুরু করে বেনিয়াটোলা স্ট্রিট মিশেছে মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডে। এক দিকে শোভাবাজার স্ট্রিট, অন্য দিকে, বিকে পাল অ্যাভিনিউ।

এক কথায় শান্ত নির্ঝঞ্ঝাট মধ্যবিত্ত একটা পাড়া। এ পাড়ার বটকৃষ্ণ পালের পরিবারে আমার জন্ম। সময়ের সঙ্গে পাড়ায় এসেছে নানা পরিবর্তন, তবু বদলায়নি পাড়ার সেই পুরনো চেহারা, মন, আর উত্তুরে সেই মেজাজটা।

সময়ের সঙ্গে এলাকার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। দু’বেলা নিয়ম করে রাস্তাঘাট পরিষ্কার হচ্ছে। পানীয় জলের জোগান বাড়াতে নতুন পাইপলাইন বসানো হয়েছে। এলাকার কাউন্সিলর শিখা সাহা এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, মানুষের সমস্যার কথা শোনেন, সমাধানেরও চেষ্টা করেন। দিন পনেরো অন্তর নিয়ম করে মশার তেল এবং রাস্তার ধারে ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হয়। রাস্তায় বসেছে জোরালো আলো।

এ অঞ্চলে বিকে পাল পার্ক যেন এক টুকরো সবুজের সমাহার। ভোরে প্রাতর্ভ্রমণকারী থেকে বিকেলে হাঁটতে আসা প্রবীণদের পাশাপাশি ছোটদের খেলাধুলোর উপযোগী। রয়েছে ফুটবল খেলার জন্য আলাদা গ্যালারিও।

সে কালে পাড়ায় খেলাধুলোর পরিবেশ ছিল অন্য রকম। বেনিয়াটোলা আদর্শ ব্যায়াম সমিতি আমাদের ক্লাব। তাঁর পরিচালক ছিলেন সত্যপদ দে। তাঁকে আমরা বন্ধুরা সকলে ভয় পেতাম। রাস্তায় বসে আড্ডা মারছি দেখলেই বলতেন, ‘‘যাও ক্লাবে গিয়ে ব্যায়াম করো।’’ আমরা বড়দের যথাসম্ভব সমীহ করে চলতাম। হয়তো মাঠে খেলতে খেলতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, পাশের বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ বকুনি দিয়ে বললেন, এখনও বাড়ি ঢুকিসনি, যা বাড়ি গিয়ে পড়তে বস!’’ মনে মনে রাগ হলেও আমরা কিছুই বলতে পারতাম না। আমরা ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি খেলতাম। শীতকাল এলেই মাঠে জোরালো আলো লাগিয়ে শুরু হত ব্যাডমিন্টন ও টেবলটেনিস খেলা। আর ছিল পাড়ার ক্যারাম প্রতিযোগিতা। সে সব আজ স্মৃতি। আজ মনে হয় ছোটদের খেলাধুলোর ইচ্ছেটা অনেকটাই কমেছে।

সেই সুখস্মৃতির মাঝেই রয়েছে কিছু তিক্তস্মৃতিও। নকশাল আন্দোলনের সেই কালো দিনগুলো। তখন সন্ধ্যার পরে আমরা ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরতাম। সেই সময়ে লেগেই থাকত বোমা-বাজি, আর যখন তখন পুলিশি তল্লাশি। সন্ধ্যার পরে রাস্তাঘাট থাকত অন্ধকারময়। পাড়ায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই স্থানীয়রা ধরে জেরা করতেন।

এ পাড়ার আড্ডারও একটা নিজস্ব চরিত্র ছিল। বিভিন্ন রকে এক এক বয়সের মানুষের আড্ডা। মনে পড়ছে, নকশাল আমলেই যবনিকা পড়ল সেই রকের আড্ডার— হয়তো কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সন্দেহে। কেউ কেউ বাড়ির রকে কাচ ও পেরেক বসিয়ে দিলেন, কেউ বা রকের অস্তিত্বটাই মিটিয়ে দিলেন চিরকালের মতো। বিক্ষিপ্ত ভাবে থেকে যাওয়া কিছু রকে ছুটির দিনগুলিতে আজও মেলে আড্ডার সেই ঝলক।

কমে এসেছে পাড়ার ঘুড়ি ওড়ানোর সংস্কৃতিটাও। বিশ্বকর্মাপুজোর দিন সেই ‘ভোকাট্টা’ রবটা যেন অচিরেই মহাশূন্যে মিলিয়ে গিয়েছে। তেমনই শীতকালে ছাদে বড়ি দেওয়া কিংবা আচার তৈরির চলটাও আজ আর চোখে পড়ে না। তখন পাড়ায় শুক্রবার সন্ধ্যা হলেই আসত মুশকিল আসান। ‘আসানি কর ওগো সত্যপীর মুশকিল আসান...’ এই বলে হাঁক দিত সে। আমরা ছোটরা তাঁকে ঘিরে ভিড় করতাম। এক হাতে কালো চামর অন্য হাতে কুপেতে জ্বলত শিখা। আমাদের মাথায় চামর বুলিয়ে কী যেন মন্ত্র পড়ে সে কপালে পরিয়ে দিত কাজলের টিপ। সেও এক দিন হারিয়ে গেল।

আজও পাড়ায় একে অপরের সঙ্গে মিলমিশ, যোগাযোগ রয়েছে ঠিকই, তবু অতীতের সেই আন্তরিকতা কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে। মনে পড়ে যায় শ্রীমন্ত দত্ত, গণেশ দত্ত, নেপালচন্দ্র দে-র মতো পাড়ার কিছু মানুষের কথা, যাঁরা নিজেদের অসুবিধার কথা অগ্রাহ্য করে সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে রাত-বেরাতে সকলের পাশে দাঁড়াতেন। তেমনই পুজোর জোগাড় করা থেকে অন্যান্য অনুষ্ঠানে পাড়ার মহিলাদের ভূমিকা ভোলার নয়।

তবে এ পাড়ার ঐতিহ্যে এখনও অনেকটা জুড়ে উৎসব। দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর পাশাপাশি নৃত্যকালীপুজোও এখানকার এক আকর্ষণ। প্রায় ২৪৫ বছরের পুরনো এই পুজো উপলক্ষে বসে মেলাও। উল্লেখযোগ্য, আজকের এই কর্মব্যস্ত যুগেও এই সব পুজোপার্বণে পাড়ার সকলের অংশগ্রহণ দেখার মতো। এই উপলক্ষে আয়োজিত যাত্রা এবং নাটকে অনেকে অভিনয় করেন দারুণ উৎসাহ নিয়ে।

তেমনই এ পাড়ার আর এক আকর্ষণ দোলের গান। দোলের সন্ধ্যায় প্রায় শ’দেড়েক মানুষ বিশেষ শোভাযাত্রায় দোলের গান গাইতে গাইতে পথ পরিক্রমা করেন। পুরনো দিনের আমেজটা ধরে রাখতে আজও থাকে হ্যাজাকের আলো, ছেটানো হয় গোলাপজল। দোলের প্রায় দু’মাস আগে থেকে শুরু হয়ে যায় গানের মহড়়া। কাছেই অধরলাল সেনের বাড়িতে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। আর আছে প্রসিদ্ধ সোনার গৌরাঙ্গ বাড়ি।

এলাকার বাজার বলতে শোভাবাজার। তবে বাজারের গণ্ডি ছাড়িয়ে শোভাবাজার স্ট্রিট ধরে ফুটপাথেও পসরা নিয়ে বসেন অনেকে। কোথাও বা গজিয়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকান। এর জন্য কোথাও কোথাও ফুটপাথে হাঁটাই দায়। অগত্যা রাস্তায় নামতে হয়। তীব্র গতিতে ছুটে আসা অটো কিংবা লরির ধাক্কায় যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। পাড়া থেকে কবেই বিদায় নিয়েছে পরিচিত ফেরিওয়ালার ডাক। তার পরিবর্তে ভ্যান রিকশায় মাইক লাগিয়ে চলছে চিনে জিনিসের বেচাকেনা। তবে উত্তরের অন্যান্য পাড়ায় যখন থাবা বসিয়েছে ফ্ল্যাট কালচার, পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে বহুতল, তখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমাদের মধ্যবিত্ত পাড়াটায় সেই হাওয়াটা লাগেনি।

হারানোর মাঝে আছে প্রাপ্তিও। তা হল এ পাড়ার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। মানুষগুলোর মধ্যে যে একতা এবং মিলমিশ আছে তা সত্যি অহঙ্কার করার মতো। সেই কারণেই পাড়ার সকলে সকলকে চেনেন— শুধু ঠিকানা দিয়ে নয়, নামে এবং ব্যক্তি হিসেবে। এটাই এ পাড়ার পরম প্রাপ্তি।

লেখক বিকে পালের পরিবারের সদস্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE