Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সাড়ে ৪ বছর পরে জিম্মায় কাদের

ছাদে লাফ পুলিশের, জালে পার্ক স্ট্রিট পাণ্ডা

ঘটনা সাড়ে চার বছর আগের। দেড় বছর হল, অভিযোগকারিণী মারা গিয়েছেন। মামলার বিচার শেষ হয়ে সাজা খাটছে তিন জন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার জের খানিক ফিকেও হয়ে এসেছিল।

হেফাজতে। কাদের (বাঁ দিকে) ও আলি। — নিজস্ব চিত্র

হেফাজতে। কাদের (বাঁ দিকে) ও আলি। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:২৯
Share: Save:

ঘটনা সাড়ে চার বছর আগের। দেড় বছর হল, অভিযোগকারিণী মারা গিয়েছেন। মামলার বিচার শেষ হয়ে সাজা খাটছে তিন জন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার জের খানিক ফিকেও হয়ে এসেছিল।

ঠিক এই পরিস্থিতিতে ধরা পড়ে গেল পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণের মূল অভিযুক্ত কাদের খান। বৃহস্পতিবার রাতে, দিল্লি ঘেঁষা উত্তরপ্রদেশের গ্রেটার নয়ডায়। একই সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছে মামলার অন্যতম অভিযুক্ত আলি খানকে, যে কিনা সম্পর্কে কাদেরের খুড়তুতো ভাই। লালবাজার জানাচ্ছে, গ্রেটার নয়ডার এক ফ্ল্যাটে দু’জন গা ঢাকা দিয়ে ছিল। খবর পেয়ে কলকাতা পুলিশের বিশেষ টিম ক’দিন আগে দিল্লি পৌঁছে যায়।

তার পরে বৃহস্পতিবার গভীর রাতের ‘সফল অপারেশন।’ যা কিনা হয়েছে রীতিমতো অ্যাকশন ফিল্মের কায়দায়— পিছু নিয়ে, ছাদে উঠে, পাশের ছাদে লাফিয়ে দুই অপরাধীকে পাকড়াও করা হয়েছে বলে গোয়েন্দা-সূত্রের খবর। ধৃতদের শুক্রবার সকালের বিমানে কলকাতায় আনা হয়। বিমানবন্দর থেকে প্রথমে লালবাজারে, পরে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। দু’জনই আপাতত পুলিশ হেফাজতে।

কিন্তু ওরা এত দিন কী ভাবে পুলিশের নাগাল এড়াতে পারল?

বস্তুত পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের পরেই কাদের যে ভাবে কলকাতা ছেড়ে চম্পট দেয়, পুলিশের একাংশের মদত ছাড়া তা সম্ভব ছিল না বলে লালবাজারের অন্দরে গুঞ্জন রয়েছে। কাদেরের গতিবিধি সম্পর্কে খবর কিন্তু আসছিল। অথচ পুলিশ রওনা হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খবরও ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল। ‘‘এক বার তো প্রায় ধরে ফেলেছিলাম। পৌঁছে শুনি, আধ ঘণ্টা আগে ভাইকে নিয়ে সে পালিয়েছে! মুম্বইয়ের হোটেল হোক বা বিহার-উত্তরপ্রদেশের আস্তানা— সর্বত্র এমন কাণ্ড ঘটেছে।’’— মন্তব্য লালবাজারের এক অফিসারের। তিনি বলেন, ‘‘কারা ওদের খবর পাচার করত, কারা সাহায্য করত, এ সবও জানার চেষ্টা হবে এ বার।’’

পার্ক স্ট্রিটের প্রাথমিক তদন্তভার ছিল কলকাতা গোয়েন্দা-পুলিশের ‘উইমেন্স গ্রিভান্স’ সেলের হাতে। অভিযান, ধরপাকড় চালাত গুন্ডাদমন শাখা। মামলার বিচার শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কাদের ধরা না-পড়ায় পুলিশ সমালোচনার মুখে পড়ে। তৃণমূল সরকারের দ্বিতীয় দফায় কতকটা ভাবমূর্তি উদ্ধারের তাগিদেই কাদেরকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের উপরে চাপ বাড়ে। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘পুরনো তদন্তদল ভেঙে না-দিয়ে গোপনে সমান্তরাল নতুন টিম গড়া হয়। নেতৃত্বে ডিসি সাউথ মুরলীধর শর্মা। আগের টিমের প্রায় কাউকেই এটা জানানো হয়নি।’’

বিশেষ টিম সূত্রের খবর: দেশের নানা জায়গায় কাদেরের যত আত্মীয়, সকলের তালিকা বানিয়ে মোবাইলের কল ডিটেল্‌স রেকর্ড ঘাঁটা শুরু হয়। কাদেরের গতিবিধি

সম্পর্কে বিশদ তথ্য মিলতে থাকে। গত ছ’মাসে সে কোথায় কোথায় ছিল, তা জানা যায়। প্রতিটি ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য অফিসারেরা পরিচয় গোপন করে সমস্তিপুর, পটনা, মুজফ্ফরনগর, ভোপালের মতো নানা জায়গায় নানা জনের বাড়িতে ঢুঁ মেরেছেন।

এ ভাবেই এক সময়ে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়ে যান—কাদের ও আলি এক সঙ্গে আছে। এবং আছে কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে। যে সূত্রে গ্রেটার নয়ডার ফয়জলের নাম উঠে আসে। কাদেরের ভাগ্নে ফয়জল ওখানে এক ফ্ল্যাটে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকে।

শুরু হয় ‘শিকার’কে ফাঁদে ফেলার তোড়জোড়। বৃহস্পতিবার কাদেরের আর এক ভাগ্নে আফজলের জন্মদিনের পার্টি ছিল দিল্লির জামিয়ানগরে। গোয়েন্দারা আঁচ করেন, পার্টি-বিলাসী কাদের নিশ্চয় যাবে। ওত পাতে পুলিশ। সঙ্গে ফ্ল্যাটের মালিককেও নিয়ে যায়, যাতে তিনি ‘ঠিক লোক’দের চিনিয়ে দিতে পারেন। মাঝ রাতে পার্টি সেরে কাদের ও আলি গাড়ি চড়ে গ্রেটার নয়ডার দিকে রওনা দেয়। পিছু নেয় পুলিশের গাড়ি। জামিয়ানগরেই ওদের পাকড়াও করা হল না কেন?

পুলিশের যুক্তি— পার্টিতে হানা দিলে গোলমাল হতে পারত। ‘‘আমরা বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে চাইনি।’’— বলছেন এক অফিসার। রাত একটা নাগাদ দু’ভাই গ্রেটার নয়ডার বাড়িতে পৌঁছয়। ততক্ষণে তারা টের পেয়ে গিয়েছে যে, পুলিশ পিছনে লেগেছে। দোতলা বাড়ির ছাদে জল-ট্যাঙ্কের ভিতরে তারা ঢুকে পড়ে। পুলিশ ছাদে উঠলে দু’জনেই পাশের বাড়ির ছাদে লাফ দেয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। টিম-সূত্রের খবর, কনস্টেবল সঞ্জীব দাস সঙ্গে সঙ্গে পাশের ছাদে ঝাঁপ দেন। তিনিই কব্জা করেন দুই শর্মাকে।

গ্রেটার নয়ডার সংশ্লিষ্ট কাসনা থানা-সূত্রের খবর: সেক্টর আলফা টু-এর এফ-৫৮ নম্বরের ফ্ল্যাটটি ভট্ট পরিবারের। তাঁদের কেউ এ দিন কথা বলতে চাননি। গৃহকর্ত্রী মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। কাসনা থানার ইন্সপেক্টর সুধীর ত্যাগী বলেন, ‘‘কাল রাতে কলকাতা পুলিশের টিম এসে আমাদের সাহায্য চায়। যৌথ অপারেশনে দু’জনকে ধরা হয়েছে।’’ স্থানীয় দোকানদারেরা জানিয়েছেন, দু’জনকে মাঝে-মধ্যে দেখা যেত। কিছু দিন থেকে আবার গায়েব হয়ে যেত।

কাদের, আলিকে এ দিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তুললে পুলিশ তাদের হেফাজতে চায়। ধৃতদের কৌঁসুলি জাকির হোসেন প্রশ্ন তোলেন, যেখানে মামলার রায় পর্যন্ত ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, সেখানে কেন পুলিশি হেফাজত? সরকারি কৌঁসুলি পীযূষকান্তি মণ্ডল যুক্তি দেন, দু’জনকে জেরা করে নতুন তথ্য উঠে আসতে পারে।

সওয়াল শুনে বিচারক এডেন লামা দু’জনকে ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Park Street Suzette Jordan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE