Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
বিষাক্ত বায়ু-২

শহুরে ফুসফুসের জন্য কি শুধুই কালো ধোঁয়া

বছরর তিরিশের যুবকটিকে পরীক্ষা করে চমকে উঠেছিলেন বক্ষ বিশেষজ্ঞ। ফুসফুসের সব বায়ুপথ তো বটেই, ফুসফুসের বায়ুথলির মধ্যেও কালো কালো ছাপ। কার্বন আর গন্ধকের সূক্ষ্ম কণা জমা হয়েছে সেখানে।

দেবদূত ঘোষঠাকুর, কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৩২
Share: Save:

বছরর তিরিশের যুবকটিকে পরীক্ষা করে চমকে উঠেছিলেন বক্ষ বিশেষজ্ঞ।

ফুসফুসের সব বায়ুপথ তো বটেই, ফুসফুসের বায়ুথলির মধ্যেও কালো কালো ছাপ। কার্বন আর গন্ধকের সূক্ষ্ম কণা জমা হয়েছে সেখানে।

বক্ষ বিশেষজ্ঞের ভয় ওই সব কণা নিয়ে নয়। তাঁর মন্তব্য, ওই সব কণার সঙ্গে মিশে থাকে বেঞ্জিনের নানা যৌগ। যা অকালেই শেষ করে দিতে পারে ওই যুবকের জীবন। ওই সব যৌগকে বইয়ের ভাষায় বলা হয় পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন বহু পরিমাণে জমলে ফুসফুসের ক্যানসার অবধারিত।

বক্ষ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া যুবকটির ফুসফুসের হাল এত কম বয়সেই এমন কেন?

জানা গেল ওই যুবক কাজ করেন শহরের উপকণ্ঠে এক মোটর গ্যারাজে, যেখানে প্রতি দিন বাস-লরি মেরামতি হয়। ওই বক্ষ বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যা, ‘‘যুবকটি গ্যারাজে কাজ করায় প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত ধোঁয়া তাঁর শরীরে নিয়মিত ঢোকে। আর আমরা যারা প্রতি দিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, বাসে চেপে যাচ্ছি, তাঁরাও গাড়ির ধোঁয়া ফুসফুসে ভরছি। আমাদের ফুসফুসেও বিষ গিয়ে জমা হচ্ছে। তবে সে তুলনায় পরিমাণ অনেক কম।’’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার এক শিক্ষকের কথায়, বিভিন্ন ভাসমান কণা বায়ুপথ ও ফুসফুসে জমলে তা থেকে অকালেই হাঁপানি হতে পারে। কিন্তু যানবাহনের ধোঁয়া ফুসফুসে গিয়ে জমা হলে, ধোঁয়ায় মিশে থাকা বেঞ্জিনঘটিত রাসায়নিকগুলি ধীরে ধীরে বায়ুথলির কোষগুলিকে মেরে ফেলে। যার নিট ফল ফুসফুসের ক্যানসার। শহরের যাঁরা বাসিন্দা, বিশেষত বয়স্ক নাগরিক এবং শিশুরা, তাঁদের পাশাপাশি যাঁরা বাইরে থেকে শহরে নানা কাজের জন্য আসছেন, তাঁরাও এই মারাত্মক দূষণের শিকার। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, অল্পেই হাঁফ ধরা ইত্যাদি নানাবিধ রোগের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

ওই শারীরবিদ্যার শিক্ষক আরও জানালেন, ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) যানবাহনের ধোঁয়া সম্পর্কে সব বড় শহরকে সতর্ক করে দিয়েছে। বেশ কিছু দেশ কলকাতা, দিল্লি, মুম্বইয়ে যাওয়া তাদের নাগরিকদের নাকে-মুখে মাস্ক পরে ঘোরার পরামর্শ দিচ্ছে — জানালেন ওই শারীরবিদ্যার শিক্ষক।

তা হলে এখন শরীর ঠিক রাখতে কী করণীয়?

বিশেষজ্ঞেরা শহরের বায়ুদূষণ রোধে নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে পুরনো ডিজেলচালিত যানবাহন পুরোপুরি তুলে নেওয়া এবং পেট্রোল-ডিজেলের পরিবর্তে ধীরে ধীরে গ্যাস এবং ব্যাটারিচালিত গাড়ি রাস্তায় নামানো। শহরে গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষার যে কেন্দ্রগুলি আছে, সেগুলি যথাযথ কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। সুভাষবাবু বলেন, ‘‘বিভিন্ন আদালত বিভিন্ন সময়ে যানবাহনের দূষণ রুখতে নানা নির্দেশ দিয়েছে। সেগুলি কার্যকর করতেই হবে।’’

দূষণ কী ভাবে

• গাড়ির ধোঁয়া

• কয়লার ধোঁয়া

• নির্মাণস্থলের সূক্ষ্ম ধুলোবালি

• ছোট কারখানার গ্যাসীয় বর্জ্য

• হাসপাতাল-নার্সিংহোমের মেডিক্যাল বর্জ্য

• জঞ্জাল পোড়ানোর গ্যাস

• বাজির কার্বন ও গন্ধক কণা

• যত্রতত্র গাছ কাটা

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একটি সমীক্ষা বলছে, অক্টোবর থেকে মার্চ —এই ছ’মাস শহরের দূষণ অনেক বেশি থাকে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর—শহরে বৃষ্টির জন্য দূষণে লাগাম পড়ে।

এই পরিস্থিতে পর্ষদের ভূমিকা ঠিক কী?

তাদের এক শীর্ষকর্তা জানান, শহরের কোন উৎস থেকে কতটা দূষণ হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট ভাবে জানার জন্য জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থাকে (নিরি) নিয়োগ করা হয়েছে। সেই সমীক্ষার রিপোর্ট পেলে ওই উৎসগুলিতে লাগাম টানতে নির্দিষ্ট ভাবে পদক্ষেপ করা হবে। সেই রিপোর্ট পেতে বছর দেড়েক লাগবে বলেও তিনি জানান।

তত দিন কি এই বিষ-বায়ু টেনে যাওয়াটাই নাগরিকদের ভবিতব্য?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Air Pollution Urban People Lung
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE