ভরসার ডাল। হেঁশেল থেকে খদ্দেরের পাতে। শহরের দুই পাইস হোটেলে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার ও স্বাতী চক্রবর্তী।
এটাও ‘এল এস ডি’। তবে জটায়ুকে কাঠমান্ডুতে বিপাকে ফেলা অদ্ভুত ঘোর লাগানো মাদক নয়। ধর্মতলার এক ব্যস্ত পাইস হোটেলের প্রবীণ মালিক এই সাঙ্কেতিক শব্দটা ব্যবহার করে থাকেন।
পথেঘাটে সস্তায় পেট ভরাতে গরিবগুর্বো-মধ্যবিত্তের জন্য এই এল এস ডি-র বিকল্প নেই। ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য তিনি রোগাটে চারাপোনার পিস কি সস্তার শুকনো কাবাব ভাতের সঙ্গে নিতে পারেন। কিন্তু থালা ভরা ভাতটা সেই ট্যালটেলে হলুদ জলে ভিজিয়ে নিতেই হবে। আদর করে সেই হলুদ জলকেই এল এস ডি বলে ডাকেন সেই হোটেল মালিক। খুলে বললে যার মানে দাঁড়ায়, ‘লাইফসেভিং ডাল’!
গত বছরখানেকে ধাপে ধাপে বাজারের দাম বাড়তে থাকলেও এ হেন ‘জীবনদায়ী ডাল’-এর উপরে দক্ষিণা চড়াতে তাই এখনও দ্বিধাগ্রস্ত গড়পড়তা ভাতের হোটেল। কাছের-দূরের মফস্সল থেকে নিত্য শহরে আসা আগন্তুক তথা অফিসটাইমের ভাতসন্ধানীদের আনাগোনায় সরগরম জানবাজারের ‘সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম’-এর মেনুর বোর্ড সে কথাই বলছে। জনৈক কর্মচারীর কাছে ডাল নিয়ে হা-হুতাশ করতেই তিনি সটান বোর্ডটা দেখালেন। সেখানে স্পষ্ট লেখা, মুগ-মুসুর ডাল: ৪ টাকা। সাধারণত, খাবারের পদগুলির পাশে দামটা চক দিয়ে লেখাই দস্তুর। দাম বাড়লে-কমলে আগেরটা মুছে সহজেই নতুন দাম লিখে ফেলা যায়। হোটেলের কর্মচারীটি বোঝালেন, ‘‘ভাল করে দেখুন, লিস্টের উপর দিকে ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারির দাম মোটামুটি এক। চকের লেখায় ওখানটায় বহু দিন হাত পড়েনি।’’ ওই তল্লাটে এক কালে দু’টাকার ডালও চলত। এখন চার টাকার ডালই চলছে বছরের পর বছর। গড়িয়াহাট বাজারের দোতলায় ‘নিউ তারা মা হোটেল’-এর রণজিৎ মাইতিও হাসলেন, ‘‘লাভ-ক্ষতির হিসেবটা আমরা মাছ-মাংস থেকে বুঝে নিই।’’ বাজারে কোন দিন কী মাছ মিলল, কেমন তার সাইজ, সেই অনুযায়ী মাছের দাম ঘন ঘন বোর্ডে মুছে ফেলা হয়। কিন্তু ডালের দাম সাধারণত অবিকৃতই থাকে।
গড়িয়াহাটের নিউ তারা মা, আদর্শ হিন্দু ও নিউ কারকো গা-ঘেঁষাঘেঁষি করা পড়শি। ডালের দাম, পাঁচ টাকা। ডাল কেনার খরচ বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। কেউ দাম বাড়ালে প্রতিপক্ষের ‘অ্যাডভান্টেজ’। তাই কেউই সাহস করছেন না। কোনও কোনও হোটেল ভাতের সঙ্গে ডাল নিখরচাতেও দিয়ে থাকে। অথচ, বছর দেড়েকে ডালের দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়েই। মুগ ডালের দাম সম্প্রতি ১৪০ টাকা কেজি পার করে ফেলেছে। দেড় বছর আগেও ১০০ টাকার নীচে দাম ছিল। মুসুর ডালও ৮০-৯০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে এখন ১১০-১৫ টাকায় ঘুরঘুর করছে। ছোলার ডালের দাম দু’বছর আগে ৪২ টাকা কেজি ছিল, এখনই সেটা ৮৫-৮৬ টাকা ছুঁয়ে ফেলেছে। অড়হর ডালের দাম ১৮০ টাকা কেজি ছাড়িয়ে গিয়েছে।
কলেজ স্ট্রিটের ভবানী দত্ত লেনে উৎকলজাত রন্ধন-শিল্পীদের ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল’-এর কর্তা শরৎচন্দ্র পণ্ডা হিসেব কষলেন, আগে ডালের পিছনে মাসভর পাঁচ হাজার টাকা খরচ হলে এখন অনায়াসে দশ হাজার টাকা গলে যাচ্ছে। তবে তাঁর কথায়, ‘‘বছরখানেক আগে এক বার সামান্য দাম বাড়িয়েছিলাম। তাই এখনই দাম বাড়ানো সম্ভব নয়।’’
এই গ্রীষ্মে রোজকার আম মুসুরের ডাল, মুগের ডাল বা মাছের মাথা দেওয়া মুড়িঘণ্টের দাম ১০-২০ টাকার মধ্যেই আটকে রয়েছে।
তবে ভাতের হোটেল মানে কখনওই স্রেফ ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নয়। মহানগরে কলেজ স্ট্রিট, ভবানীপুর, শিয়ালদহ, বি বা দী বাগে রোজকার খাইয়ে ও হোটেল-মালিকদের মধ্যে এক ধরনের আত্মীয়তাও গড়ে ওঠে। তখন দাম বাড়ানোটাও কঠিন হয়ে পড়ে। অধুনা যেমন বিপাকে পড়েছে, খিদিরপুরের ‘ইয়ং বেঙ্গল হোটেল’ বা কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় রমানাথ মজুমদার লেনের ‘মহল হোটেল’। ইয়ং বেঙ্গলে রোজকার মুগ বা মুসুর ডাল সামান্য পাতলা হয়েছে। কিন্তু দাম পাল্টায়নি। হোটেলে বৃহস্পতিবার ধোকার ডালনা বা মঙ্গলবার ডালের বড়ার ঝোল খাওয়ার জন্যও তো অনেকে সপ্তাহভর মুখিয়ে থাকেন। ‘‘চেনা খদ্দেরদের চাপ দিতে পারব না, তাই দাম ৩০ টাকাই রেখেছি। কিন্তু তিনটের বদলে এখন দু’টো করে ধোকা বা বড়া দেওয়া হচ্ছে। এটুকু আপস না-করে গতি নেই।’’— বললেন হোটেলের কর্ত্রী পৃথা রায়বর্মণ।
মহল হোটেলের সন্দীপ দত্ত, প্রজ্ঞান ভট্টাচার্যেরাও নিরুপায়। পাঁচ টাকার মুসুর ডাল এখনও দিচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু মুগের ডালের দাম বাড়াতে হয়েছে। তাঁদের সোনামুগের ঘন ডাল এখনও মরসুমি সব্জির টুকরো বা নারকোলের কুচির মণিমুক্তোয় সমৃদ্ধ। দেড় মাস আগেও দাম মোটে ১০ টাকা ছিল। এখন বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা। ধোকার ডালনার দামও ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা হয়েছে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে বাংলাদেশি রান্নার ঠেকগুলোয় ভুনি খিচুড়ির দাম এখনও বাড়েনি ঠিকই। কিন্তু ডাল-ভর্তা বা রোজকার আমিষ-নিরামিষ ডালের দাম দু’-পাঁচ টাকা করে বাড়ছে। ডালের দামের দোসর হয়ে শুক্তোর বড়ি বা চাটনির সঙ্গী পাঁপড়ের দামেও চাপ পড়ছে।
গরিবের ডাল-ভাতের সুখটুকু চৌপাট হওয়া নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতা চলছে, দু’টাকার চাল + ১৮০ টাকা ডাল। কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে ডালের সিন্ডিকেট ফুলেফেঁপে ওঠা নিয়েও ডাল মে কুছ কালা-র অভিযোগ। শনি-দুপুরেই কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে এসে নাকতলার রবীন জানা মাছ-ভাতের সঙ্গী ডালটুকু একেবারে শেষে তারিয়ে তারিয়ে খাবেন বলে রেখে দিলেন। বললেন, ‘‘যা দাম, বাড়িতে ডাল খাওয়া কমাতে বাধ্য হয়েছি! এখানে বাটির একটি ফোঁটাও ফেলতে ইচ্ছে করে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy