Advertisement
১৫ মে ২০২৪

পাড়ায় তাণ্ডব, ‘দেবাদা’ দেরিতে জানলেন কেন

তিনি বলছেন, ‘‘একটু আগেও যদি খবর পেতাম, আটকে দিতাম এত বড় তাণ্ডব।’’ তবে অনেকেরই বক্তব্য, এলাকার সব রকম ভাল-মন্দে জড়িয়ে থাকার পরেও তিনি সময়ে জানতে পারলেন না কেন, এটাই তো রহস্যের।

দেবাশিস কুমার

দেবাশিস কুমার

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৪১
Share: Save:

তিনি বলছেন, ‘‘একটু আগেও যদি খবর পেতাম, আটকে দিতাম এত বড় তাণ্ডব।’’ তবে অনেকেরই বক্তব্য, এলাকার সব রকম ভাল-মন্দে জড়িয়ে থাকার পরেও তিনি সময়ে জানতে পারলেন না কেন, এটাই তো রহস্যের।

এখান থেকেই পণ্ডিতিয়া টেরাসের ফোর্ট ওয়েসিস আবাসনে তাণ্ডবের উৎস সন্ধানে নয়া বাঁক মিলেছে।

তিনি মানে দেবাশিস কুমার। আবাসন লাগোয়া তেঁতুলতলা ও হাজরা রোডের বস্তিগুলিতে ঘুরলে বোঝা যায়, কাউন্সিলর তথা মেয়র পারিষদ দেবাশিসবাবুই কার্যত এলাকার শেষ কথা। তাঁর প্রভাব এতই যে, ভাল-মন্দে, সঙ্কটে-সমস্যায় ‘দেবাদা’র উপস্থিতি অনিবার্য।

শাসক দলের টিকিটে তিনি একাধিক বার এই এলাকার কাউন্সিলর হয়েছেন। হয়েছেন মেয়র পারিষদও। তবে বর্তমান শাসক দলে আসার আগেও এই দেবাশিস কুমার নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে, সব রাজনৈতিক দলকে হারিয়ে কাউন্সিলর হিসেবে প্রথম নির্বাচিত হন ১৬ বছর আগে।

আর ঠিক এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, শনিবার গভীর রাতে হাজরা রোডের দুর্ঘটনায় তেঁতুলতলা বস্তির মিথিলেশ রায়ের মৃত্যু হয়েছে বলে ভুয়ো খবরে (আসলে মারা যান অভিজিৎ পাণ্ডে) ক্ষোভ তৈরি হওয়ার পর বস্তিবাসীরা তাঁর কাছে এক বার না-গিয়ে নিজেরা ভাঙচুরের সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?

দেবাশিসবাবুর দাবি, ভাঙচুরের আগাম পরিকল্পনা করে আবাসনে চড়াও হননি বস্তিবাসীরা। ওই মুহূর্তে পাড়ার ছেলের মৃত্যুর খবরে, সেই সঙ্গে ঘাতক গাড়ির সঙ্গে আবাসনের একটি গাড়ির নম্বরের সংখ্যাগুলি নাটকীয় ভাবে মিলে যাওয়ায়, ঝোঁকের মাথায় ভাঙচুর হয়ে গিয়েছে।

তেঁতুলতলা বস্তির বাসিন্দা, বছর চল্লিশের রামপ্রবেশ রায় বললেন, ‘‘মিথিলেশের অনেক বন্ধুবান্ধবই আশপাশে থাকত। খবর পেয়ে চলে এসেছিল তারা। দেওদার স্ট্রিটের বস্তি থেকেও এসেছিল অনেকে।’’ নিজের এলাকার বস্তির পক্ষ নিয়ে দেবাশিসবাবুরও দাবি, তাঁর এলাকার বস্তি থেকেই যে সকলে সে দিন ভাঙচুর চালিয়েছে, তা নয়। আশপাশ থেকেও অনেকে এসেছিল। তাঁর ইঙ্গিত দেওদার স্ট্রিট বস্তির দিকে।

দেওদার স্ট্রিটের বস্তিবাসীদের সাফ বক্তব্য, ‘‘পাশেই ঝামেলা হচ্ছে শুনে দেখতে গিয়েছিলাম। গাড়ি ভাঙতে নয়।’’ ওই এলাকার কাউন্সিলর শুকদেব চক্রবর্তী জানালেন, তিনি ঘটনার সময় কলকাতায় ছিলেন না। বুধবারই ফিরেছেন। ঘটনা শুনে তিনিও অবাক। বললেন, ‘‘এখানকার ছেলেরা বাইরে গিয়ে তাণ্ডব করেছে, কখনও শুনিনি। তবে কে কার বন্ধু, কোন পরিস্থিতিতে কার মধ্যে কোন আবেগ কী ভাবে মাথাচাড়া দেয়, তা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।’’

ঘটনার পরে তেঁতুলতলা বস্তি থেকে যে ভাবে ‘নির্বিচারে’ ছেলেদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, তা নিয়েও খুশি নন দেবাশিস কুমার। তাঁর দাবি, সিসিটিভি ফুটেজে ভাল করে দেখা হোক ভাঙচুরের মুখগুলো। তার পরেই গ্রেফতার করা হোক। নইলে কাগজওয়ালা, দুধওয়ালা থেকে শুরু করে আবাসনের গাড়ির চালক, অনেককেই বিনা অপরাধে লক-আপে পোরা হচ্ছে। কৌতূহলবশত ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর ‘অপরাধে’ তাঁদের গ্রেফতার করাটা ঠিক নয়। কিন্তু পুলিশের একটি সূত্রের খবর, সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওই আবাসনে কর্মসূত্রে যুক্ত কিছু লোকই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন গাড়িগুলি। পরোক্ষ মদতও দিচ্ছেন ভাঙচুরে। এমনটা কেন?

এলাকার সাবেক বাসিন্দাদের অনেকের মতে, এর পিছনে আছে এক ধরনের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য। ২০০৬ সালে অভিজাত ফোর্ট ওয়েসিস আবাসন তৈরির পরে অনেক নতুন মানুষ এসে থাকতে শুরু করেন, যাঁদের মানসিকতা ও সামাজিক অবস্থান বস্তিবাসীদের চোখে ‘বেমানান।’

রামকৃষ্ণ সেবক সমিতির সেক্রেটারি, ৭২ বছরের বিজন ঘোষ বলেন, ‘‘এলাকার কোনও কর্মকাণ্ডেই অভিজাত এই আবাসনের লোকজনের ‘সহযোগিতা’ মেলে না। দু’টো বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা সামাজিক শ্রেণিকে মেলানো সহজ নয়।’’ এবং ঠিক এই দূরত্ব থেকেই, গত দশ বছর ধরে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগ। অনেকের মতে, একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই আবেগের অভিঘাতেই এমন তাণ্ডব।

যদিও দেবাশিস কুমার পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, দু’রকম আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মধ্যে বিভাজন থাকবেই। কিন্তু এরা পরস্পরের পরিপূরকও বটে। কারণ, আবাসনের বাসিন্দাদের দুধ দেওয়া, খবরের কাগজ পৌঁছনো, গাড়ি ধোয়া, ঘরের কাজের জন্য পরিচারক— সবই মেলে বস্তি থেকে। তাই সহাবস্থান নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

তবে এক দল বস্তিবাসী আবাসনে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়ে ৭৪টি গাড়ি ভেঙেছে, যেখানে জনপ্রতিনিধি থেকে পুলিশ, কাউকেই সময়মতো পাওয়া যায়নি— এটা তো বাস্তব ঘটনা। এমনকী, পুলিশবাহিনী এসে পৌঁছচ্ছে না দেখেও কাউন্সিলর নিজে পুলিশ ডাকতে উদ্যোগী হননি। দেবাশিসবাবুর মতে, প্রথমে হয়তো ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি পুলিশ। বাহিনী পাঠাতে তাই দেরি হয়ে যায়। পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেন, ‘‘এক সময়ে লাঠি চালানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুলিশ। আমি আটকেছি। কারণ সমস্যা তাতে আরও জটিল হতো। আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছেই ছেলেদের বকে বলি, তোরা আরও আগে কেন আমাকে জানাসনি?’’

কিন্তু সব কিছুর পরেও তো এটা সত্যি, যে শতাধিক উন্মত্ত যুবক আবাসনে ঢুকে নির্বিচারে গাড়ি ভেঙেছেন। আর সেই ঘটনার অন্তর্তদন্ত করতে গিয়ে বারবারই মনে হচ্ছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোথাও যেন রাশ টেনে রাখছেন এলাকার প্রিয় ‘দেবাদা’। এ বিষয়ে দেবাশিসবাবুর যুক্তি পরিষ্কার। ‘‘যারা ভাঙেনি, তাদের শাস্তি অনুচিত। ফুটেজ খতিয়ে দেখে তবেই সিদ্ধান্ত নিক পুলিশ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Debashish kumar panditiya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE