Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এমন দুর্দিনেও নীরব কেন সিপি, প্রশ্ন আম-পুলিশের

শুধু এক বার ফোঁস করেছিলেন। তাতে ওঁকে চেয়ারটাই খোয়াতে হয়েছিল। লালবাজার-নবান্নের বড় অংশের মতে, পূর্বসূরি রণজিৎ পচনন্দার সেই অভিজ্ঞতা থেকে কলকাতার বর্তমান পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ অক্ষরে অক্ষরে শিক্ষা নিয়েছেন। তাই গত তিন বছরে একটি বারের জন্যও তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া গতের বাইরে গিয়ে কিছু করেননি। শাসকদলের লোকজনের হাতে সতীর্থদের বারবার নিগৃহীত হতে দেখেও তিনি যে ভাবে মুখে কুলুপ-হাতে বেড়ি পরে বসে থেকেছেন, সেটাকে ‘রাজধর্ম’ পালনে চূড়ান্ত ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছে কলকাতা পুলিশের নিচুতলা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৫ ০৩:৪০
Share: Save:

শুধু এক বার ফোঁস করেছিলেন। তাতে ওঁকে চেয়ারটাই খোয়াতে হয়েছিল।

লালবাজার-নবান্নের বড় অংশের মতে, পূর্বসূরি রণজিৎ পচনন্দার সেই অভিজ্ঞতা থেকে কলকাতার বর্তমান পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ অক্ষরে অক্ষরে শিক্ষা নিয়েছেন। তাই গত তিন বছরে একটি বারের জন্যও তিনি মুখ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া গতের বাইরে গিয়ে কিছু করেননি। শাসকদলের লোকজনের হাতে সতীর্থদের বারবার নিগৃহীত হতে দেখেও তিনি যে ভাবে মুখে কুলুপ-হাতে বেড়ি পরে বসে থেকেছেন, সেটাকে ‘রাজধর্ম’ পালনে চূড়ান্ত ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছে কলকাতা পুলিশের নিচুতলা। এবং হালের ভাইঝি-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে তাঁর ভূমিকা দেখে-শুনে বাহিনীর অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, সুরজিৎবাবুর কি আদৌ আর ওই পদে থাকা মানায়?

ঠিক চার বছর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল যখন রাজ্যের শাসনক্ষমতা দখল করল, তখন কলকাতার পুলিশ কমিশনার পচনন্দা। নিজের অতি ঘনিষ্ঠ ওই আইপিএস অফিসারকে মমতা প্রকাশ্যেই আদর করে ‘পচা’ সম্বোধন করতেন। এ হেন পচনন্দাও শেষে মুখ্যমন্ত্রীর চক্ষুশূল হয়ে পড়েন, যার মূলে ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া গার্ডেনরিচ-কাণ্ড। কী রকম?

গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে গোলমালের জেরে এক সাব-ইন্সপেক্টর নিহত হন। বাহিনীর মনোবল রক্ষায় শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে তৃণমূলের বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবালের (মুন্না) নামে এফআইআর করেছিল পচনন্দার পুলিশ। বেশ কিছু দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পরে মুন্নাকে ধরাও দিতে হয়। লালবাজার সূত্রের ইঙ্গিত, মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন হয়ে থাকবেন, নাকি সতীর্থদের আস্থা ফেরাবেন— পরিস্থিতির চাপে এই দুয়ের মধ্যে দ্বিতীয়টিকে বেছে নিতে পচনন্দা বাধ্য হয়েছিলেন।

তার মাসুলও ওঁকে দিতে হয়। কলকাতা পুলিশের সর্বোচ্চ পদ থেকে অপসারিত হওয়ার পরে মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে পচনন্দার আর ঠাঁই হয়নি। পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের পর্যবেক্ষণ, সুরজিৎবাবু সেই ‘ভুল’ করতে নারাজ। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বলেন, ‘‘উনি সৎ অফিসার। নব্বইয়ের দশকে ডিসি (ট্র্যাফিক) থাকাকালীন যথেষ্ট ভাল কাজ করেছিলেন। কিন্তু উনি কমিশনার হয়ে আসার কিছু দিনের মধ্যে বোঝা গেল, ওঁর মধ্যে সেই ঝাঁঝটা যেন আর নেই!’’

সুরজিৎবাবুর মতো কর্তব্যপরায়ণ অফিসারের ‘ঝাঁঝ হারানো’র পিছনে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলয়ে ঢুকে পড়াকেই দায়ী করছেন নবান্ন-লালবাজারের প্রাক্তন-বর্তমান অধিকারিকদের অনেকে। ‘‘চার দিক দিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। নিচুতলার মনোবল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরের সঙ্গী হিসেবে নিজের নামটি তো উনি পাকা করে ফেলেছেন!’’— কটাক্ষ এক প্রাক্তন অফিসারের। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতা পুলিশকে লন্ডন পুলিশ বানাতে চান মুখ্যমন্ত্রী। সেই উদ্যোগে সামিল হওয়াটা নিঃসন্দেহে বড় প্রাপ্তি!’’

তার উপরে সম্প্রতি কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝিকে ঘিরে যে কাণ্ড ঘটে গেল, পথ-বিধি লঙ্ঘন থেকে শুরু করে পুলিশের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও সরকারি কাজে বাধাদানের মতো গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ওই তরুণীকে যে ভাবে ছাড় দেওয়া হল, এবং যে ভাবে বিধানসভায় ঘটনাটিকে ‘বাচ্চা মেয়েদের কাজ’ আখ্যা দিয়ে লঘু করে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মীদের ‘কাউন্সেলিংয়ের’ দাওয়াই দিলেন, তার পরেও কমিশনার একেবারে নীরব থাকায় সমালোচনার তির আরও জোরালো হয়েছে। নিচুতলার আক্ষেপ, বাহিনীর প্রধান হিসেবে কমিশনারের এই ভূমিকা চরম দুর্ভাগ্যজনক। ওঁদের বক্তব্য, ‘‘মেয়রের ভাইঝি দেবপ্রিয়া, রাসবিহারী মোড়ে ২২ মে রাত দশটা-সওয়া দশটা নাগাদ ডিউটিরত সেই ট্র্যাফিক কনস্টেবল চন্দন পাণ্ডে, অথবা ওই রাতে টালিগঞ্জ থানায় দেবপ্রিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছেন যে সাব ইনস্পেক্টর, সেই এ কে মিশ্রের মধ্যে কে সত্যি কথাটা বলছেন, তা নিয়ে কমিশনার মুখ খুললেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যেত। আমরা ভরসা পেতাম। বুঝতাম, উনি আমাদের পাশে আছেন।’’

তবে সুরজিৎবাবু মুখ খোলার প্রয়োজনীয়তা এখনও বোধ করেননি। এমতাবস্থায় সাধারণ পুলিশকর্মীদের মধ্যে ধন্দ তুঙ্গে। মধ্য কলকাতার একটি থানার এক এসআই বলছেন, ‘‘রাসবিহারীতে ঠিক কী হয়েছিল, জানি না। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই স্বরাষ্ট্র-সচিবের কাছে থেকে জেনে বিধানসভায় বিবৃতি দিয়েছেন। সচিব নিশ্চয় রিপোর্ট পেয়েছেন সিপি’র কাছে। চন্দন পাণ্ডে অন্যায় করে থাকলে সিপি’র উচিত ছিল তাঁর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। না-করে থাকলে উচিত ছিল মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে খণ্ডন করা। কিন্তু উনি তো কিছুই করলেন না!’’

তাই গোটা বিষয়টি নিয়ে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের মধ্যে ধন্দ-সংশয় যেমন বাড়ছে, তেমন চড়ছে নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার পারদও। বস্তুত সাম্প্রতিক অতীতে আলিপুর থানায় হামলা, গোপালনগরে পুলিশ নিগ্রহ, গিরিশ পার্কে এসআই’কে গুলি, একবালপুরে পুলিশকে মার, কিংবা এনআরএসে পুলিশকে হেনস্থার মতো বিভিন্ন ঘটনার পরে দেখা গিয়েছে, শাসকদলের ঘনিষ্ঠ কারও দিকে আঙুল উঠলেই লালবাজারের কর্তারা গুটিয়ে গিয়েছেন। কুলুপ এঁটেছেন মুখে।

ভাইঝি-কাণ্ডেও সেই ট্র্যাডিশন বহাল। কেউই কথা বলতে রাজি নন। বুধবার কমিশনারের দফতর থেকে জানানো হয়েছিল, জুলাইয়ের শেষে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে লন্ডন যাবেন বলে সিপি সফর-প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তাই বাক্যালাপ করতে পারবেন না। বৃহস্পতিবারেও আনন্দবাজারের একাধিক প্রতিবেদক পুলিশ কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার (সদর)-কে ফোন করে রাসবিহারী-কাণ্ডে লালবাজারের অবস্থান জানার চেষ্টা করেন। কেউ ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি। রাসবিহারী-কাণ্ডকে তিনি কী চোখে দেখছেন, তা জানতে আনন্দবাজারের তরফে এ দিন ৯টি প্রশ্ন সিপি’কে দু’বার ই-মেল করে পাঠানো হয়। জবাব মেলেনি। বেলা দেড়টা নাগাদ একই প্রশ্ন ই-মেলে পাঠানো হয় যুগ্ম কমিশনার ট্র্যাফিক সুপ্রতিম সরকার (বর্তমানে যিনি যুগ্ম কমিশনার সদরের দায়িত্বও অস্থায়ী ভাবে সামলাচ্ছেন) এবং ডিসি ট্র্যাফিক সলোমন নেসাকুমারকে। তাঁরাও সাড়া দেননি। ই-মেল পাঠানোর কথাও এমএমএসে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিন কর্তাকে। কেউই অবশ্য প্রাপ্তিস্বীকার করেননি।

এই পরিস্থিতিতে পুলিশ-প্রধানের ভূমিকা নিয়ে বিরোধীরাও আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছে। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম এ দিন বলেন, ‘‘বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী যখন মেয়রের ভাইঝিকে আড়াল করে ট্র্যাফিক কনস্টেবলকেই কর্তব্য পালনের দায়ে প্রায় খলনায়ক বানিয়ে দিয়েছেন, তার পরে অন্তত পুলিশ কমিশনারের নড়ে-চড়ে বসা উচিত ছিল!’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘পুলিশ তো আদতে তৃণমূলেরই সেবাদল! মুখ্যমন্ত্রী তো জানিয়েছেন, ওই কনস্টেবলের মতো এখনও যাঁরা সরীসৃপ হয়ে যাননি, তাঁদের কাউন্সেলিং দরকার!’’

কাজেই কমিশনারের আচরণে অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না ওঁরা। ‘‘পরিস্থিতির চাপে পচনন্দাও একটা সময়ে বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। চাপ এখন তুঙ্গে। তাতেও কি কর্তাদের পা সরবে না?’’— হতাশ প্রশ্ন এক কনস্টেবলের। থানায় থানায়, ব্যারাকে ব্যারাকে তাঁরই কথার প্রতিধ্বনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE