Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল

বায়োপ্সি রিপোর্ট মিলতেই ৩ মাস

বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে সময় লাগে সাত থেকে ১০ দিন। সরকারি হাসপাতালে তিন সপ্তাহ লেগে যায়। কিন্তু সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে কলকাতার জাতীয় স্তরের ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট (সিএনসিআই)। বায়োপ্সি রিপোর্ট পেতে কাবার হয়ে যাচ্ছে তিন মাস! তত দিন পরবর্তী ধাপের চিকিৎসার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকছেন রোগীরা।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৬ ০১:৪৭
Share: Save:

বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে সময় লাগে সাত থেকে ১০ দিন। সরকারি হাসপাতালে তিন সপ্তাহ লেগে যায়। কিন্তু সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে কলকাতার জাতীয় স্তরের ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট (সিএনসিআই)। বায়োপ্সি রিপোর্ট পেতে কাবার হয়ে যাচ্ছে তিন মাস! তত দিন পরবর্তী ধাপের চিকিৎসার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকছেন রোগীরা। বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। অস্ত্রোপচারের পরে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি কোনটা হবে— তা নিয়ে চিকিৎসকেরা কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেন না। ফলে রোগটা ছড়িয়ে পড়ছে অনেকের ক্ষেত্রেই। মুমূর্ষু রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে প্রতি পদে।

সারা দেশের ২৫টি আঞ্চলিক ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম এই চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল। কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগে চলা ২০০ শয্যার হাসপাতালটি সম্প্রসারণের কাজও শুরু হয়েছে বছর কয়েক আগে। রাজারহাটে তৈরি হচ্ছে নতুন ক্যাম্পাস। এমন একটি কেন্দ্রে বায়োপ্সির মতো অত্যন্ত জরুরি একটি পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে এত সময় কেন লাগছে, তার কোনও সুনির্দিষ্ট কারণ দেখাতে পারেননি কেউই। বরং এ নিয়ে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে শুরু হয়েছে চাপানউতোর।

মেডিক্যাল অঙ্কোলজি ও সার্জিক্যাল অঙ্কোলজির একাধিক চিকিৎসক জানান, যে ভাবে সব চলছে তাতে তাঁদের পক্ষে রোগীদের যথাযথ পরিষেবা দেওয়াটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হাসপাতালের কর্তাদের একাংশও স্বীকার করে নিয়েছেন, ‘‘বরাত ভাল থাকলে দু’মাসে রিপোর্ট। নয়তো তিন মাস লেগে যাচ্ছে।’’ এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ, বিকেলেই কার্যত ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায় প্যাথলজি বিভাগের। ফলে দুপুরের পরে জরুরি ভিত্তিতে রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হলে তা কোনও ভাবেই সম্ভব হয় না।

কেন এই অব্যবস্থা? সুপার জহর মজুমদারকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর জবাব, ‘‘এটা আমার এক্তিয়ারের বাইরে। আমারও উপরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন।’’

এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ অধ্যক্ষ জয়দীপ বিশ্বাসও। তিনি শুধু বলেন, ‘‘যা বলার প্যাথলজি বিভাগের প্রধানই বলবেন।’’

প্যাথলজি বিভাগের প্রধান গৌতম মণ্ডলের বক্তব্য, অল্প কিছু ক্ষেত্রে দেরি হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়মতো রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি পাল্টা দায় চাপিয়েছেন চিকিৎসকদের একাংশের উপরে। গৌতমবাবুর কথায়, ‘‘আমরা তো সাধ্যমতো চেষ্টা করি। কিন্তু এটা টিমওয়ার্ক। বায়োপসির জন্য যে নমুনা আসে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য, এমনকী রোগীর বয়স, রোগটা কবেকার, সেটুকুও লেখা থাকে না। হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়। কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডাক্তারদের পিছনে ছুটতে হয়। এ সব প্রতিবন্ধকতা নিয়েও আমরা যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ করার চেষ্টা করি।’’ ওই বিভাগের এক ডাক্তারের অভিযোগ, বহু ডাক্তার নিজেদের স্বার্থেই বাইরের ল্যাবরেটরিতে বায়োপ্সির জন্য নমুনা পাঠান। অজুহাত হিসেবে তাঁরা হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের বিলম্বকে দায়ী করেন।

এই অভিযোগ অবশ্য পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকেরা। তাঁদের পাল্টা অভিযোগ, সমস্যাটা কর্মসংস্কৃতির। একে প্যাথলজি বিভাগে চিকিৎসক-অচিকিৎসক কর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তার উপরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই কাজে অনীহা।

হাসপাতালের এক কর্তা বলেন, ‘‘এখানকার প্যাথলজি বিভাগটি খুবই দুর্বল। ক্যানসারের চিকিৎসায় ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি নামের একটি পরীক্ষা খুবই প্রয়োজনীয়। সেই পরীক্ষা চালু করার ব্যাপারে বহু বার কথা হলেও কিছু হয়নি। বরং সপ্তাহের পর সপ্তাহ বায়োপসির নমুনা যে ভাবে ফেলে রাখা হচ্ছে, তাতে পরে রোগীর বাড়ির লোক নিজেদের খরচে তা বাইরের ল্যাবে ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রির জন্য পাঠালেও তা করা যাচ্ছে না। কারণ দীর্ঘদিন ফেলে রাখায় নমুনার অ্যান্টিজেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’’

কতটা জরুরি ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি পরীক্ষা? বিশিষ্ট প্যাথলজিস্ট সুবীর দত্ত জানান, ক্যানসারটি ঠিক কোন ধরনের, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী, তা জানার জন্য এই পরীক্ষাটি অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যা অগ্রগতি, তাতে এই রিপোর্ট ছাড়া বহু ক্ষেত্রেই এখন ডাক্তাররা চিকিৎসা শুরু করেন না।

জাতীয় স্তরের একটি কেন্দ্রে তা হলে কেন সেই পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে না? মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এত বড় হাসপাতালে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগেরই অস্তিত্ব নেই। ফলে অপারেশন থিয়েটার সত্যিই জীবাণুমুক্ত হল কি না, তা বোঝার উপায় থাকে না। রোগীদের কোনও নমুনার কালচার সেনসিটিভিটি করার দরকার পড়লেও বাইরে পাঠাতে হয়।’’ কেন হল না মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ? সুপার বা অধ্যক্ষ, কারও কাছেই উত্তর মেলেনি।

দায়িত্ব নিয়ে ঠিক যে ভাবে চাপানউতোর চলেছে হাসপাতাল কর্তাদের মধ্যে, সে ভাবেই চলেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের মধ্যেও। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, সিএনসিআই সংক্রান্ত রিপোর্ট দিল্লিতে যায়। তাই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এ বিষয়ে কথা বলতে পারবে। আর কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তাদের দাবি, এ ব্যাপারে এখনও তাঁদের কাছে কোনও রিপোর্টই আসেনি। তাই যা জানার, রাজ্যই জানে।

পারস্পরিক এই দায় এড়ানোর আবহে মারণ রোগের শিকার গরিব মানুষদের ভবিষ্যৎ কী? উত্তর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE