Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

অস্ত্রোপচার ‘এড়াচ্ছেন’ ডাক্তারেরা

কোথাও ৩৫, কোথাও ৪৭, কোথাও আবার ৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ‘প্ল্যান‌‌্ড ওটি’, অর্থাৎ আগে থেকে পরিকল্পিত অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে সামান্য ঝুঁকিও নিতে চাইছেন না চিকিৎসকেরা। ফলে বাতিল হতে থাকা অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বাড়ছে।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৭ ০১:৩৯
Share: Save:

কোথাও ৩৫, কোথাও ৪৭, কোথাও আবার ৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ‘প্ল্যান‌‌্ড ওটি’, অর্থাৎ আগে থেকে পরিকল্পিত অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে সামান্য ঝুঁকিও নিতে চাইছেন না চিকিৎসকেরা। ফলে বাতিল হতে থাকা অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালে এমনিতেই ‘ডেট’ পেতে গেলে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়। তার উপরে ইদানীং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যে ‘অবিশ্বাস’-এর বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তার জেরে সরকারি চিকিৎসকেরাও সামান্য সমস্যার আগাম আঁচ পেলে তা থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। সব মিলিয়ে ভোগান্তি বাড়ছে রোগীদের।

বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে এক প্রৌঢের বাইপাস সার্জারির কথা ছিল দু’সপ্তাহ আগে। সম্প্রতি চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন, ‘হাই রিস্ক সার্জারি’। তাই আপাতত সেটি করা যাবে না। আতান্তরে প়ড়েছেন বাড়ির লোকেরা। কারণ, অস্ত্রোপচার যতই ঝুঁকির হোক, সেটা না করালে মৃত্যু নিশ্চিত। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘বন্ডে সই করার পরেও ডাক্তার রাজি হচ্ছেন না। আমরা বারবার বলছি, যা হবে, আমরা সেটা মেনে নেব। কিন্তু অন্তত চেষ্টাটা তো করা হোক।’’ কী বলছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক? তাঁর উত্তর, ‘‘অপারেশনের পরে এ দিক-ও দিক কিছু হলে মার খাওয়ার হাত থেকে কে বাঁচাবে? বন্ডের কাগজ তখন হাওয়ায় উড়ে যাবে। এই ঝুঁকিটা আমি নেব কেন?’’

কলকাতার আর এক শিশু হাসপাতালে একটি শিশুর অস্ত্রোপচার নিয়ে এমনই বিপদের মুখে পড়েছেন তার পরিবারের লোকেরা। কয়েক মাস বয়সের, কম ওজনের ওই শিশুটিকে অ্যানাস্থেশিয়া দিতে রাজি হচ্ছেন না কোনও অ্যানাস্থেটিস্ট। এ ভাবে চলতে থাকলে তাকে ভিন্ রাজ্যে নিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ থাকবে না। তাই সেই প্রস্তুতিই নিতে শুরু করেছেন তার বাবা-মা।

কলকাতার ‘ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেল্থ’-এর অধিকর্তা অপূর্ব ঘোষ জানান, প্রতিনিয়ত এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা। ‘‘এত দিন তো আমরাও ঝুঁকি নিয়ে অনেক কাজ করেছি। কিন্তু আমাদেরও তো পরিবার রয়েছে। তাই ছোট ছোট কারণে সার্জন, অ্যানাস্থেটিস্টরা ‘না’ বলে দিচ্ছেন। এ ভাবে কত দিন চলবে জানি না।’’

বস্তুত, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবায় এমন অভিনব অচলাবস্থার শেষ কোথায়, তার হদিস কারও কাছে নেই। শল্য-চিকিৎসক সুমিত চৌধুরীর কথায়, ‘‘অস্ত্রোপচার চলাকালীন আকস্মিক কোনও জটিলতা আর গাফিলতিকে এক করে ফেলছেন অনেকেই। তাই এই বিপত্তিটা বাধছে। যেমন, কোনও বয়স্ক মানুষের বাড়িতে হার্ট অ্যাটাক হলে সেটা মেনে নেন বাড়ির লোকেরা। কিন্তু সেই হার্ট অ্যাটাকই হাসপাতালে অস্ত্রোপচার চলাকালীন হলে ডাক্তারের গাফিলতি ভেবে নিয়ে তাঁরাই চড়াও হন। সব কিছু যে আগাম আঁচ পাওয়া যায় না, সেটাই মানতে চান না বহু মানুষ।’’ বিভিন্ন হাসপাতালের ‘আজ সার্জারি, কাল বাড়ি’ জাতীয় বিজ্ঞাপনও মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি করছে বলে তাঁর অভিমত। কোনও অস্ত্রোপচারই যে আদতে সামান্য নয়, এই বোধটা তাঁদের তৈরি হচ্ছে না।

চোখের চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘চোখের জটিল অস্ত্রোপচারের সংখ্যাও অনেকটা কমে গিয়েছে। সার্জনরা রাজি হচ্ছেন না। এক চুল এ দিক-ও দিক হলে রোগীর বাড়ির লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ডাক্তারকে মারধর করা হচ্ছে, টাকা আদায় করার চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা অবিশ্বাসের পরিস্থিতি।’’

রোগীদের স্বার্থে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনও এতে সিঁদূরে মেঘ দেখছেন। তাঁদের বক্তব্য, এ তো উল্টো চাপ তৈরি হচ্ছে। গাফিলতি তো পরের কথা, আগে চিকিৎসাটা শুরু হোক। বহু ক্ষেত্রে তো সেটাও আটকে থাকছে।

তবে বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, চিকিৎসক-রোগী সম্পর্কের এই অবিশ্বাস শুধু এখানেই বাড়ছে তা নয়। সমীক্ষায় ধরা পড়েছে ‘মেডিকো-লিগ্যাল’ সমস্যার জেরে ইংলন্ডের চিকিৎসকদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। যে অস্ত্রোপচারের সাফল্য নিশ্চিত, সে দিকেই এগোতে চাইছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

surgeries planned operations Nursing Home Doctors
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE