রবার স্ট্যাম্পই যখন প্রেসক্রিপশন। নিজস্ব চিত্র
নিজেরা বরাত দিয়ে নিজেদের খরচাতেই কিছু স্ট্যাম্প তৈরি করিয়েছেন হাওড়া হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক। তাতে তাঁদের নিজেদের ‘পছন্দ’ করা ওষুধপত্রের নামের লম্বা তালিকা রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন রকম শারীরিক পরীক্ষার নাম। সেই স্ট্যাম্পের ছাপই ওই চিকিৎসকেরা নির্দ্বিধায় সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে আসা রোগীর কার্ডে দিয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনার কথা জানতে পেরে হতবাক স্বাস্থ্যকর্তারা। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী।
শুধু সরকারি তালিকার অন্তর্ভূক্ত এবং হাসপাতালের স্টোরে মজুত রয়েছে এমন ওষুধের নামই ওই চিকিৎসকেরা স্ট্যাম্পে রেখেছেন, তা একেবারে নয়! বরঞ্চ তাঁরা জানিয়েছেন, নিজেরা যে ওষুধকে ‘ভাল’ বলে মনে করেন, সেগুলিকে রেখেই স্ট্যাম্প বানানো হয়েছে। তার মধ্যে সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করেই অনেক ব্র্যান্ডেড ওষুধও রয়েছে!
হাওড়া হাসপাতালে প্রেসক্রিপশন হওয়ার কথা অনলাইনে। কিন্তু ই-প্রেসক্রিপশন তো দূরে থাক, কিছু চিকিৎসক যে প্রেসক্রিপশন হাতেও না লিখে তৈরি স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছেন, সেই খবর পেয়ে স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা স্তম্ভিত! স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, ‘‘প্রথমে বিষয়টি শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি। তার পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, এমনটাই হচ্ছে। নিন্দা জানানোর ভাষা পাচ্ছি না। কত দূর সাহস হলে এটা কেউ করতে পারে? বিস্তারিত তদন্ত হবে। দোষীরা সাজা পাবেন।’’
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সকালে হাওড়া হাসপাতালের আউটডোরে গিয়ে দেখা গেল, ত্বক বিভাগের এক ডাক্তারবাবু নির্বিকার রোগীদের কার্ডে বিভিন্ন ওষুধ আর শারীরিক পরীক্ষা লেখা স্ট্যাম্প লাগিয়ে যাচ্ছেন। ওষুধের নামের পাশেপাশে সংখ্যায় পেন দিয়ে লিখে দিচ্ছেন কোনটা কত দিন চলবে। কোন কোন পরীক্ষা করাতে হবে, তা-এ পেনের টিক চিহ্ন দিয়ে দিব্যি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, এই স্ট্যাম্প কে তৈরি করিয়েছে? জবাব মিলল— ‘আমি।’
সরকারি জায়গায় এই রকম স্ট্যাম্প দিয়ে ওষুধ লেখা যায়?
ওই চিকিৎসক বললেন, ‘‘এ ছাড়া সম্ভব নয়। এত ভিড়। কত জনকে আলাদা করে হাতে ওষুধ আর পরীক্ষা লিখব? অনেক সময় লেগে যায়।’’
যে সব ওষুধ হাসপাতালে রয়েছে, শুধু সেগুলির নাম দিয়েই কি স্ট্যাম্প তৈরি করেছেন?
এ বার উত্তর এল, ‘‘না না। অনেক ভাল ওষুধ হাসপাতালে নেই। যেগুলিতে ভাল কাজ হয়, সেগুলি লিখেছি। তার মধ্যে জেনেরিক-ব্র্যান্ডেড, সব আছে। হাসপাতালে না পেলে রোগী বাইরে থেকে কিনবে।’’
আরও পড়ুন: চুমকিদের নিয়েই যায়নি নিশ্চয় যান
কিন্তু কোনও বিভাগের আউটডোরে যাঁরাই আসবেন, সকলের জন্য একই রকম ওষুধ কী করে হবে?
ওই চিকিৎসক বলেন, ‘‘অনেকগুলি ওষুধের নাম দিয়ে স্ট্যাম্পটা বানিয়েছি। ছাপ দেওয়ার পরে যাঁর যেগুলি দরকার, তার পাশে টিক দিয়ে দিই।’’
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শুধু ত্বক নয়, মেডিসিন-অর্থোপেডিক্স, সাইকিয়াট্রির মতো অনেক বিভাগেই কিছু চিকিৎসক এই নিয়ম চালাচ্ছেন।
অথচ সরকারি নিয়ম হল, রোগী আউটডোরে দেখানোর জন্য প্রথমে একটি স্লিপ বানাবেন। আউটডোরে ডাক্তারবাবু তাঁকে প্রেসক্রিপশন লিখে দেবেন। হাসপাতালে কী কী ওষুধ মজুত রয়েছে, চিকিৎসক তা জানবেন এবং সেই মতো ওষুধ দেবেন। সব ওষুধেরই জেনেরিক নাম লেখা হবে। যদি একান্ত এমন কোনও ওষুধ দিতে হয় যা হাসপাতালে নেই, সেটা হাসপাতাল কিনে দেবে।
একাধিক স্বাস্থ্যকর্তার বক্তব্য, এই নিয়ম করা হয়েছিল যাতে সরকারি হাসপাতালের রোগীকে ওষুধ বা পরীক্ষার জন্য এক টাকাও খরচ করতে না হয়। কিন্তু কিছু চিকিৎসকের এই নিয়মে সমস্যা হচ্ছে। ওষুধ সংস্থা বা ল্যাবোরেটরিগুলি থেকে কমিশন খাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই তাঁরা নানা রকম পথ বার করছেন। ই-প্রেসক্রিপশনেও তাঁদের অনীহা। কারণ তাতে ইচ্ছেমতো আউটডোর কার্ডে স্ট্যাম্প দিয়ে ওষুধ লেখা, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা— সব স্বাস্থ্য ভবনে ধরা পড়ে যাবে।
হাওড়া হাসপাতাল সূত্রের খবর, স্টোরে কখন কোন ওষুধ কত রয়েছে, তা ওয়ার্ডে এবং আউটডোরে বসে যাতে চিকিৎসকেরা জানতে পারেন, তার জন্য অনলাইন সিস্টেম করার কথা ছিল। দু’বছর আগে তার জন্য ২০টি কম্পিউটার কেনা হয়। সেই সব কম্পিউটার এখনও একটি ঘরে স্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে, লাগানো হয়নি। হাসপাতালে এন্ডোস্কোপিও দীর্ঘদিন বন্ধ। মেশিন সারানো হয় না। দেদার এন্ডোস্কোপি করানো হয় বাইরে থেকে। হাসপাতালের সুপার নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘‘আমি কিছু জানি না।’’ সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কেটে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy