ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
বলা যায় রত্নখনি!
না, মাটির গভীরে থাকা কোনও খনি নয়, এই খনির নাম হাওড়া স্টেশন চত্বর। যেখানে স্টেশন সংলগ্ন সাবওয়ে, স্টেশন চত্বর, বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাথের প্রতিটি ইঞ্চি বিক্রি হয় মোটা টাকায়। যাকে সাংকেতিক ভাষায় বলা হয় ‘ডালা’। যে ডালার যত জায়গা— তার নজরানা তত বেশি। অভিযোগ, পূর্ব ভারতের ‘গেটওয়ে’ এই স্টেশন ও তার চত্বরে বসা ডালাকে ঘিরেই চলে এক শ্রেণির পুলিশ ও ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক নেতাদের দাদাগিরি। রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে দাদারাও বদলে যায়। লেজুড় থাকে পুলিশের একাংশ।
অভিযোগ, রাজ্যে যত দিন ক্ষমতাসীন ছিল বামফ্রন্ট তত দিন স্টেশন চত্বরে ‘তোলাবাজি’র অবাধ সাম্রাজ্য ভোগ করার অভিযোগ উঠেছিল বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। এ জন্য হাওড়া স্টেশন চত্বরের প্রথম শ্রেণির এক নেতাকে দল থেকে সরেও যেতে হয়েছিল। রাজ্যে রাজনৈতিক পালা বদলের পরে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। অভিযোগ, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম কয়েক বছর স্টেশন চত্বরে পুলিশ কোনও হকার বসতে না দিলেও বর্তমানে গোটা এলাকা, সাবওয়ে ও ফুটপাথ চলে গিয়েছে হকার, বেআইনি স্টল এবং ভাতের হোটেল মালিকদের দখলে। রীতিমতো অফিস বানিয়ে চলছে তোলাবাজি। এবং এই বেপরোয়া ‘তোলাবাজি’র অভিযোগ উঠেছে স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড চত্বরের দায়িত্বে থাকা এক শ্রেণির তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। এই নিয়ে দলেই শুরু হয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দলের একাংশের অভিযোগ, কয়েক জন নেতার মদতে বর্তমানে ডালার রেট প্রায় তিনগুন বাড়ানো হয়েছে। আগে হকারদের যেখানে ৬ বর্গফুট জায়গার জন্য দিতে হতো ১০০ টাকা, বর্তমানে দিতে হচ্ছে ৩০০ টাকা প্রতিদিন। স্টেশন চত্বরে দীর্ঘ দিন ধরে বাম শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে থাকা এক নেতার বক্তব্য, ‘‘বাম আমলে ডালা নিতে গেলে যে টাকা দিতে হতো, তাতে হকারদের পকেটে কিছু টাকা অন্তত থাকত। এখন পুলিশ ও নেতাদের ‘তোলা’র টাকা গিয়ে লাভের গুড় পিঁপড়েয় খাচ্ছে।’’
একই অভিযোগ করেছেন হাওড়ার সাবওয়েতে নিত্যদিন ডালা নিয়ে বসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হকার। তাঁর অভিযোগ, ‘‘এখন জায়গা যত বড়, ডালার দামও তত বেশি। না দিতে চাইলে চলে আসে ডালা সন্তোষের লোকজন। মারধরের ভয় দেখায়। পুলিশকেও হপ্তা দিতে হয়।’’
হাওড়া স্টেশন চত্বরকে যদি তিন ভাগে ভাগ করা যায়, তা হলে হাওড়ার বাসস্ট্যান্ড, কলকাতা বাসস্ট্যান্ড ও গঙ্গার ঘাট ঘেঁষা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড চত্বরে প্রতিদিন হকার বসেন ২০০ থেকে ২৫০ জন। এ ছাড়া প্রতিদিন বিকেলে সাবওয়েতে বসেন আরও ১০০ জন হকার। পাশাপাশি, রয়েছে ৬টি বেআইনি ভাতের হোটেল এবং ৪০টি স্টল। তৃণমূলের একাংশের খবর, এই সব হকার, হোটেল মালিক ও স্টল মালিকদের দৈনন্দিন তোলা দেওয়ার হার আলাদা। তবে তা কারওরই দৈনিক ১০০ টাকার নীচে নয়। হাও়ড়া স্টেশন এলাকায় দলের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তৃণমূলের
এক নেতা বলেন, ‘‘আমাদের দলের এক শ্রেণির নেতার মদতে পুরো
স্টেশন চত্বর ও সাবওয়ে ফের হকারদের দখলে চলে গিয়েছে। মোটা টাকা নিয়ে হকার বসানো হচ্ছে। এ নিয়ে দলের উপরতলায় প্রতিবাদ করেও ফল হয়নি।’’
একই মতামত দলের বর্ষীয়ান নেতা ও উত্তর হাওড়ার প্রাক্তন বিধায়ক এবং হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান অশোক ঘোষের। তিনি বলেন, ‘‘দলে থাকা এই সব তোলাবাজদের সম্পর্কে দলকেই খোঁজ নিয়ে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে।’’
যদিও তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘যে সব লোকজন তৃণমূলের নাম করে এই টাকা তুলছেন, তাঁদের নামে কেউ আমাদের মৌখিক ভাবে অভিযোগ করলেই তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর করব। তৃণমূল কখনও তোলাবাজি সমর্থন করে না।’’
কিন্তু পুলিশ কেন এই বেআইনি দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না?
হাওড়া স্টেশন চত্বর-সহ উত্তর হাওড়ার দায়িত্বে থাকা হাওড়া সিটি পুলিশের এসিপি (উত্তর) স্বাতী ভাঙ্গারিয়া বলেন, ‘‘মাঝেমাঝেই হকার উচ্ছেদ অভিযান করা হয়। কিন্তু কিছু দিন পরে তাঁরা ফিরে এসে বসতে শুরু করেন। উৎসবের মরসুম চলায় অভিযান বন্ধ ছিল। ফের শুরু হবে।’’
এসিপি এ কথা বললেও, হাওড়া স্টেশনে হকাররাজ নিয়ে এক পুলিশকর্তার মতে, স্টেশন চত্বরটি যেহেতু বকলমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল চালায়, তাই তাঁরা উদ্যোগ না নিলে সমস্যার সমাধান কোনও দিনই হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy