Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঘুমিয়ে পাড়া, পার্কে নিঃশব্দে পুড়ে গেলেন বৃদ্ধা

রোজকার মতো শুক্রবারও ভোর সওয়া চারটেয় ঘুম থেকে উঠেছিলেন বিজয়গড়ের এক নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা কমল সাহা। স্নান সেরে তিনতলার ঠাকুরঘরে যান পুজো সারতে। তখনই জানলা দিয়ে চোখে পড়ে, উল্টো দিকের ছোট পার্কটায় দোলনার পাশ থেকে ধোঁয়া উঠছে।

কল্পনা বর্ধন।নিজস্ব চিত্র

কল্পনা বর্ধন।নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বিজয়গড় শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৫০
Share: Save:

রোজকার মতো শুক্রবারও ভোর সওয়া চারটেয় ঘুম থেকে উঠেছিলেন বিজয়গড়ের এক নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা কমল সাহা। স্নান সেরে তিনতলার ঠাকুরঘরে যান পুজো সারতে। তখনই জানলা দিয়ে চোখে পড়ে, উল্টো দিকের ছোট পার্কটায় দোলনার পাশ থেকে ধোঁয়া উঠছে। ওই পার্কে এখন সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে। শুকনো পাতা-আবর্জনা জড়ো করে মাঝেমধ্যেই জ্বালিয়ে দেন পুরকর্মীরা। কমলবাবু ভেবেছিলেন, এটাও তেমনই ধোঁয়া। তখনও তিনি জানেন না, ঠিক উল্টো দিকের ওই পার্কে শেষ রাত থেকে পুড়ছেন আস্ত একটা মানুষ, তাঁরই প্রতিবেশী বৃদ্ধা কল্পনা বর্ধন। বয়স ৭২।

‘‘ধোঁয়া দেখে কিছুই বুঝিনি। সময় নিয়ে পুজো সেরেছি অভ্যেস মতো। তার পরে নীচে নেমে ঘর থেকে বেরোই।’’— বললেন কমলবাবু। তখনও আলো ফোটেনি। পার্ক লাগোয়া গুমটিতে দোকান খুলতে যাচ্ছিলেন কমলবাবু। ফুলের দোকান রয়েছে তাঁর। বেরিয়েই দেখেন, পার্কের ধোঁয়ার উৎস এক জন জ্বলন্ত মানুষ! ‘‘একটা শরীর পুড়ে কালো হয়ে দলা পাকিয়ে গিয়েছে। মুখ তো দূরের কথা, দেহটা পুরুষ না নারীর, তা-ও বোঝা যাচ্ছিল না। ছোট হয়ে যাওয়া হাত-পা পুড়ে বেঁকে গিয়েছে। পেটের কাছে সামান্য ধিকিধিকি আগুন। সেখান থেকেই বেরোচ্ছে ধোঁয়া।’’— বলতে বলতে এখনও শিউরে উঠছেন কমলবাবু। তখন ৪টে ৪৫ মিনিট।

কমলবাবুর চিৎকারে জড়ো হয়ে যান প্রতিবেশীরা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমে যায় ছোট্ট পার্কটায়। সকলেই বিস্মিত, আতঙ্কিত। পুলিশে ফোন করছেন কেউ। কেউ বা ডাকছেন দমকল। অথচ, কেউ এক বারও এগিয়ে যাচ্ছেন না পুড়ে যাওয়া মানুষটাকে একটু জল দিতে। কেউ চিকিৎসারও চেষ্টা করছেন না। এমন ঘটনা প্রশ্ন তোলে, তা হলে কি এতটাই অমানবিক হয়ে গিয়েছে এই শহর?

‘‘অমানবিক নয়। ভয়। সেই সঙ্গে বিস্ময়। আমরা সাহস পাইনি ওই অবস্থায় এগিয়ে যাওয়ার। কেউ খুন করে ফেলে রেখে যেতে পারে। কী করে ঝুঁকি নেব?’’— বললেন কমলবাবুর বৌদি সন্ধ্যা সাহা। তাঁর বৌমা মিতালি সাহা বললেন, ‘‘অমানবিকতার প্রশ্নই নেই। যখন প্রথম দেখা গিয়েছে, তখন ওই মহিলা পুড়ে কালো হয়ে দলা পাকিয়ে পড়ে রয়েছেন। আগুনও নিভেই গিয়েছে।’’

এখানেই পাওয়া যায় বৃদ্ধা কল্পনা বর্ধনের দগ্ধ দেহ। নিজস্ব চিত্র

এলাকার বাসিন্দা অসীম মজুমদার এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘এখানে এখনও পাড়ার সকলের খবর সকলে রাখে। কারও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন সকলে। তাই অমানবিকতার প্রশ্নই ওঠে না। আসলে প্রথম যখন লোক জানাজানি হল, তখন আর আগুন নেই। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, মানুষটি শেষ হয়ে গিয়েছেন। জলও দেওয়া হয় একটু পরে। বিন্দুমাত্র প্রাণের সম্ভাবনা থাকলেই নিয়ে যাওয়া হতো হাসপাতালে।’’

পারিবারিক ও এলাকা সূত্রের খবর, খুবই হাসিখুশি এবং মিশুকে স্বভাবের ছিলেন কল্পনাদেবী। পাড়ার সকলের সঙ্গে সদ্ভাব ছিল। সকলকে ডেকে ডেকে গল্প করতে ভালবাসতেন তিনি। পারিবারিক অশান্তির কথাও জানা যায়নি। তা হলে হঠাৎ কেন এমনটা করলেন? কল্পনাদেবীর বড় মেয়ে ঝর্না সাহা বলেন, ‘‘রক্তচাপ, হাঁপানি— এ সব শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে একটু কষ্ট পেতেন মা। কিন্তু এত বয়সেও সক্ষম ছিলেন, নিজের সব কাজ নিজেই করতেন। কোনও অবসাদের কথা কখনও জানতে পারিনি। মাকে তো ফিরে পাব না, কোনও দিনও জানা হবে না কেন এমনটা করল মা।’’— চোখে আঁচল চাপা দেন ঝর্নাদেবী।

ভোরে পাড়ায় হইহই শুনে পার্কে এসে ভিড় জমিয়েছিলেন কল্পনাদেবীর ছেলে-বৌমা শান্ত বর্ধন ও রূপালি বর্ধনও। তাঁরাও অবাক হয়ে দেখেছেন এমন বীভৎস মৃত্যু। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বোঝেননি, তাঁদেরই মা ও ভাবে পুড়েছেন! তত ক্ষণে পুলিশ এসে গিয়েছে। ভিড় আরও বেড়েছে। এই সময়ে ভোর ছ’টায় অফিস যাচ্ছিলেন নির্মল ভৌমিক। কল্পনাদেবীর জামাই। কাছেই বাড়ি তাঁর। ভিড় দেখে এবং লোকমুখে শুনে স্ত্রীকে, অর্থাৎ কল্পনাদেবীর মেজো মেয়ে পান্না ভৌমিককে জানান, পার্কে কেউ পুড়ে মারা গিয়েছেন।

‘‘আমি গিয়ে দেখি, পুড়ে যাওয়া দেহটাকে সবাই ঘিরে রয়েছে। তখনও বিন্দুবিসর্গ জানি না। হঠাৎই মনে হল, মা কই? মায়ের সব ব্যাপারে এত কৌতূহল, এই ভিড়ে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না কেন? ঘরে এসে দরজা খুলে মাকে ডাকি। মা ঘরে নেই। স্টোভে রান্নার জন্য মা কেরোসিন তেল আনতেন। সেই জারও দেখতে পাইনি। ভাবলাম, মা কি তা হলে এত সকালে রেশনের তেল তুলতে গেলেন?’’— বলছিলেন পান্নাদেবী। ফের পার্কে ফিরে যান তিনি। আর সে সময়েই লক্ষ করেন, পার্কের বাইরে পড়ে রয়েছে কেরোসিনের জার। ওই জার তাঁর চেনা, মায়েরই রান্নাঘরে রাখা থাকত। এর পরে আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, পুড়ে যাওয়া ওই মহিলা তাঁরই মা।

আরও পড়ুন:

‘দত্তক ছেলের’ কী দরকার! মোদীকে বিঁধলেন প্রিয়ঙ্কা

পুলিশ জানিয়েছে, ভোরে খবর পেয়েই ছ’টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছে কল্পনাদেবীর দেহ উদ্ধার করেন তাঁরা। এলাকায় প্রাথমিক তদন্ত সেরে, কথাবার্তা বলে সাড়ে ছ’টার দিকে পুড়ে যাওয়া দেহটি হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে মৃত বলে ঘোষণা করে হয় কল্পনাদেবীকে। তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন বলেই প্রাথমিক তদন্তে জানিয়েছে পুলিশ। বারবার প্রশ্ন উঠেছে, এক বৃদ্ধা অত ভোরে ঘর থেকে বেরিয়ে এ ভাবে গায়ে আগুন দিলেন, অথচ কেউ জানতে পারল না গোটা তল্লাটে? এখানেই অবাক সকলে। প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, গায়ে আগুন জ্বলতে শুরু করলে তো চাইলেও চিৎকার না করে থাকা সম্ভব নয়। রাতের নিস্তব্ধতায় সেই চিৎকার তো কানে আসারই কথা! তা হলে কি ঘরে আগুন লাগিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি?

ঘরে কোনও কেরোসিন তেল পড়ে ছিল না বলেই জানা গিয়েছে কল্পনাদেবীর পরিবার সূত্রে। তাঁর পুত্রবধূ রূপালি বর্ধন জানান, বাড়ির একতলায় একাই থাকতেন কল্পনাদেবী। তিনতলায় থাকতেন ছেলে-বৌমা। নীচে কখন দরজা খুলে মা বেরিয়েছেন, টের পাননি বিন্দুমাত্র। ভোরে চেঁচামেচি শুনে আর পাঁচ জনের মতোই পার্কে ভিড় করেছিলেন তাঁরা। জানতেও পারেননি, পুড়ে যাওয়া মানুষটি তাঁদেরই মা!

রূপালিদেবী বলেন, ‘‘কাল রাতেও কথা হল, সাড়ে দশটা নাগাদ খেয়ে শুয়েছিলেন মা। ভোরের মধ্যে কী করে এত বড় কাণ্ড হয়ে গেল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Burned Death Elderly Lady Park
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE