রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি তথা ডায়গনস্টিক সেন্টার। সোমবার ফোনে বলা হল— পিজি-তে ভর্তি রোগীর রক্তপরীক্ষা করাতে বেসরকারি ওই ল্যাবের নাম বলেছেন চিকিৎসকেরা। ওপার থেকে এক মহিলার জবাব: ‘‘কী কী টেস্ট, ওয়ার্ড, পেশেন্টের নাম-বেড নম্বর বলে দিন। যে কোনও ওয়ার্ডে গিয়েই আমাদের লোক রক্ত নিয়ে আসতে পারবে। তবে রাতের দিকে বা সকাল-সকাল হলে ভাল হয়। তখন হাসপাতাল একটু ফাঁকা থাকে। যে যাবে, তাঁর হাতে পুরো টাকা দিতে পারেন। অর্ধেক দিলে বাকিটা রিপোর্ট নেওয়ার সময়ে দিতে হবে।’’
একই কথা বলা গেল হরিশ মুখার্জি রোডের একটি ল্যাবরেটরিকে। সেখানেও পুরুষকণ্ঠ বললেন, ‘‘আমরা তো প্রায়ই যাই। ওয়ার্ড থেকেই ব্লাড নিয়ে আসব। ৯০০ টাকা লাগবে। ওখানেই হাফ টাকা দিয়ে দেবেন।’’
পরের ফোন শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের এক ডায়গনস্টিক ল্যাবরেটরিতে। সেখানেও এক মহিলা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। পিজি-র ওয়ার্ডে গিয়ে ব্লাড টানি। শুধু গাইনি ওয়ার্ডে একটু সমস্যা। মেডিসিন ওয়ার্ড হলে একটু সুবিধা হয়। হাউসস্টাফদের একটু জানিয়ে রাখবেন। ওঁরা সবাই চেনেন আমাদের। অসুবিধা হবে না।’’
সত্যিই কি এ ভাবে বাইরের যে কেউ সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢুকে রোগীর রক্ত নিতে পারে?
উত্তর মিলল শেষোক্ত ল্যাবরেটরির কর্মীকে ভার দিতেই। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ এসএসকেএমের ‘ফিমেল ইমার্জেন্সি অবজার্ভেশন ওয়ার্ড’-এ এক রোগিণীর রক্ত নিতে যেতে বলা হয়েছিল তাঁকে।
সঠিক সময়ে টেকনিশিয়ান দিব্যি ওয়ার্ডে ঢুকে সকলের সামনেই রক্ত নিলেন। কেউ বাধা দিলেন না। এক নার্স জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কে পাঠিয়েছে আপনাদের? আমাদের হাউসস্টাফ?’’ বলা হল, ‘‘হ্যাঁ।’’ ব্যস! আর অসুবিধা হল না। হাউসস্টাফ বললেও কেন অপরিচিত বহিরাগত হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢুকে রক্ত নেবেন, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলেন না। রক্ত নিয়ে বাইরে এসে হাতে–হাতে একশো ষাট টাকা নিলেন ওই ল্যাব-কর্মী।
নিয়মকানুন বা হাসপাতালের সুরক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহিরাগত টেকনিশিয়ানের ওয়ার্ড থেকে রক্ত নিয়ে যাওয়ার এই রেওয়াজ ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’-র তকমা পাওয়া রাজ্যের পয়লা নম্বর সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএমে বহুদিন ধরেই চলছে বলে অভিযোগ ছিল। সেই ছবিটাই স্পষ্ট হল আনন্দবাজারের এই সরেজমিন তদন্তে।
বিষয়টি নিয়ে তিতিবিরক্ত খোদ কর্তৃপক্ষ। ক্ষুব্ধ বহু সিনিয়র চিকিৎসকও। কলেজ কাউন্সিলের বৈঠকে বহু বার বিষয়টি উঠলেও সুরাহা হয়নি। অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্র বলেন, ‘‘বিষয়টি জানি। কিন্তু কেউ লিখিত অভিযোগ করেন না বলে ব্যবস্থা নিতে পারি না।’’ তাঁর দাবি, যেহেতু চিকিৎসার দায়িত্বে প্রধানত জুনিয়র ডাক্তাররাই থাকেন, তাই বাড়ির লোক অভিযোগ করে তাঁদের চটাতে চান না। অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘‘বেশ কিছু জুনিয়র ডাক্তার এই চক্রে জড়িত। এসএসকেএমের আশপাশে একাধিক প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের সঙ্গে তাঁদের একাংশের আঁতাত রয়েছে। রোগী-প্রতি ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে এঁরা ৫-১০ শতাংশ কমিশন পান।’’
পিজি-তে রক্ত নিতে যাওয়া ওই টেকনিশিয়ানও কথায় কথায় বলেছেন, ‘‘ইমার্জেন্সি অবজারভেশন, সার্জারি, মেডিসিনের মতো ওয়ার্ডে আমরা বেশি যাই। নিরাপত্তার একটু কড়াকড়ি হলে জুনিয়ার ডাক্তারেরা রোগীর বাড়ির লোকের হাতে ভায়াল পাঠিয়ে দিতে বলেন। তাতে ডাক্তারবাবুরাই রক্ত টেনে আমাদের পাঠিয়ে দেন। আমাদের সঙ্গে অনেক বড় ল্যাবেরও যোগ রয়েছে। সেখানে রক্ত পরীক্ষা করালে টাকা ও সময় একটু বেশি লাগবে।’’
খোদ প্রদীপবাবুও মানছেন, ওই ডাক্তারদের চাপে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে গরিব মানুষ এক-দু’দিনে সব টাকা খরচ করে ফেলেন। অথচ, হাসপাতালে ওই পরীক্ষাগুলিই হয়তো তাঁরা নিখরচায় বা অনেক কম খরচে করতে পারতেন। গত সপ্তাহে কিছু প্রেসক্রিপশন অডিট করে প্রদীপবাবু নিজেও দেখেছেন বিশেষত রাতে এমন অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা হয়েছে। তাঁর আরও অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে ল্যাবগুলিই হাসপাতালে দালাল লাগায়। তাঁরা রোগীর বাড়ির লোককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওয়ার্ডে ঢুকে পরীক্ষার জন্য রক্ত নিয়ে যান।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানান, আরজিকরের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সেখানেও এমন অভিযোগ একাধিক বার পেয়েছেন। কাউকে হাতেনাতে ধরতে পারেনননি। তাঁর আফশোস, ‘‘সর্ষের মধ্যেই ভুত থাকলে আর ভুত ধরা যাবে কী করে! শুভবুদ্ধির উদয় না হলে কিছু করা খুব কঠিন।’’
তা হলে সরকারি হাসপাতালে রোগীর নিরাপত্তা কোথায়? ওয়ার্ডে ঢুকে তো রোগীকে জখম, এমনকী খুনও করে যেতে পারে যে কেউ! প্রদীপবাবু জানান, তাঁরাও চিন্তিত। ডাক্তারদের অনেকেই অভিযোগ করছেন, হামেশাই বেসরকারি টেকনিশিয়ানদের ওয়ার্ডে বা বাইরে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। তবে খুব তাড়াতাড়ি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে শম্ভুনাথ হাসপাতালে একটি ২৪ ঘণ্টার ডায়গনস্টিক ক্লিনিক চালু হচ্ছে। যার একটি কাউন্টার হবে এসএসকেএমে। অধ্যক্ষের আশা, এতে সমস্যা কমবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy