আতর ভরা হরেক শিশি।
কার্নিসের নকশা ঝুলনি, খড়খড়ি আর ঝোলা বারান্দা। উঁচু বাড়ির দেওয়াল বেয়ে নেমে আসা গাছের শিকড়। লাল মসজিদের ঝকঝকে রুপোলি চুড়োয় সোনালি তুলির টান। চোখ নামাতেই দেখা যায়, ঐতিহ্যের এ পথে হাজার লোকের ব্যস্ততা। হরেক দোকানের সারির মধ্যে নজর টানে নকশাদার পাঞ্জাবি, জারদৌসি কাজের টুপি, সুগন্ধি, সুরমা আর শৌখিন পিতলের সম্ভার। সময় যেন এক মুহূর্তে বহু বছর পিছিয়ে যায়।
তখনও গ্যাসবাতি বসেনি চিৎপুর রোডে। কেরোসিন বাতি ছিল কোথাও কোথাও। চওড়া খোলা নর্দমা ছিল রাস্তার ধারে। এ শহরের পুরনো রাস্তা গঙ্গাতীরের চিৎপুর তখন বাণিজ্যে জমজমাট। কিন্তু অন্ধকারে খরিদ্দার মেলা ভার! তাই ভোর থেকেই বেচাকেনার শুরু। ভোর পাঁচটায় রবীন্দ্র সরণি আর কলুটোলার কোণে ফৌজদারি বালাখানার একতলায় দোকান খুলে বসে পড়তেন হাজি খুদা বক্স। সন্ধ্যায় ঝাঁপ পড়ে যেত। নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ১৮৫৬ সালে মেটিয়াবুরুজে আসার বহু আগেই কনৌজের কারখানা থেকে সুগন্ধি নিয়ে এ শহরে চলে আসেন খুদা বক্স ও তাঁর ছেলে নবি বক্স। ১৮২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই দোকান আজও একই জায়গায়। ভাড়াটা বেড়ে হয়েছে ১২০০ টাকা। কয়েক পা দূরেই রয়েছে কলকাতার আতর ঐশ্বর্যের ১৪০ বছরের আর এক সাক্ষী। নাখোদা মসজিদ তৈরি হয়েছে এ সবেরও বহু পরে। মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে আরও খানদুয়েক আতরের দোকান। কোনও এক অজানা কারণে কলকাতার আতর সাম্রাজ্য এ অঞ্চলেই আটকে থেকেছে।
সেই সাম্রাজ্য ঘেঁটে ঋতুর সঙ্গে বদলে আতর সংগ্রহকারী এখন হাতে গোনা। গরমে বেল, জুঁই, গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দনের পাশাপাশি মনের আরাম দেয় খস সুগন্ধি। আগেকার দিনে গরমে, পাটের ঝোলানো খসে জল ছিটিয়ে ঠান্ডা রাখা হত ঘর। বিশেষ ঘাস থেকে তৈরি খস আতর সেই ঘ্রাণ মনে করায়। শীতকালে শামামা, মুস্ক, হিনার সুঘ্রাণ গায়ে মাখতে এখনও পছন্দ করেন গন্ধবিলাসীরা। জাফরান-সহ বিভিন্ন মশলার মিশ্রণে তৈরি হয় শামামা। মুস্ক তৈরিতেও লাগে বিভিন্ন মশলা। আতরের সব থেকে জরুরি উপাদান চন্দন তেল। দুর্মূল্য চন্দন তেল এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের মিশ্রণে তৈরি খাঁটি আতরের দাম তাই বেশি। দশ গ্রাম আতরের দাম হয় ছ’শো থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। আতর তৈরিতে কম করে সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগে। তবে আগর গাছ থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি উদ আতর সময় ও খরচসাপেক্ষ। তাই এর দামও বহুগুণ বেশি। এ ছাড়া দু-তিন রকম খাঁটি আতর মিলিয়ে তৈরি হায়াতি, সাবা এবং অপ্সরাও জনপ্রিয়।
পরখ: হাতে ছুঁইয়ে গন্ধের যাচাই। —নিজস্ব চিত্র।
অথচ রাজা-নবাবদের আগল থেকে বার করে আনা আতর কিন্তু এক সময়ে বাঙালি বনেদি ঘরেও আদর পেয়েছিল। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের মনে ধরেছিল গোলাপ আর জুঁইয়ের সুগন্ধি। ঠাকুরবাড়ি থেকে নিয়মিত বরাত আসত আতরের। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শাহিদ সুরাবর্দি, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান-সহ বহু নেতারা এসেছেন কলুটোলার আতর সাম্রাজ্যে। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের বংশধর, প্রয়াত রাজ্যপাল নুরুল হাসান এবং গনি খান চৌধুরীর পরিবার সাবেক আতরের একনিষ্ঠ খরিদ্দার। জাকারিয়া স্ট্রিটে থাকাকালীন বিড়লা পরিবারেও নিয়মিত যেত চন্দন সুগন্ধি, বলছিলেন খুদা বক্সের নবম বংশধর নেওয়াজউদ্দিন আল্লা বক্স। স্মৃতি রোমন্থনে উঠে এল সাবেক ফুলবাগানের নাম মাহাত্ম্য। বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছেই ছিল বিশাল ফুল বাগিচা। সেই ফুল থেকেই এ শহরে আতর তৈরি হত। সে সব চুকেছে স্বাধীনতারও আগে। এখন আতর আসে কনৌজের কারখানা থেকে।
যদিও তা কেনেন কিছু পুরনো খেয়ালের মানুষ। এ ছাড়া ইদ, বনেদি বিয়ে, দুর্গাপুজোয় আতরের বিক্রি হয়। অন্য এক আতর ব্যবসায়ীর কথায় কিছুটা হতাশার সুর। তাঁর মতে, এখন তো বহু মানুষের হাতেই অঢেল টাকা। তবু লোকে সুগন্ধি বলতে বোঝেন, বিদেশি পারফিউম। ফলে আতর ব্যবসা তলানিতে ঠেকেছে। অথচ খাঁটি আতর এক বার যিনি ব্যবহার করবেন, তিনি বাঁধা খরিদ্দার হতে বাধ্য। নয়া প্রজন্মকে আতর প্রেমে মজিয়ে দিতে অবশ্য অনলাইন ব্যবসার কথা ভাবছেন, জানালেন সফিকুদ্দিন আল্লা বক্স। তাঁর মতে, সরকারি সহযোগিতা পেলে, বেঁচে যাবে ঐতিহ্য। এ শহরে অবশ্য ‘বিশ্ব বাংলার’ শোরুমে এখন গোলাপ, চন্দন, জান্নাতুল ফিরদৌস ও হায়াতির মতো আতর বিক্রি হচ্ছে।
কিন্তু দীর্ঘ লড়াই করে টিকে থাকা সুগন্ধ কত দূর ছড়াবে?
উত্তরটা অজানাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy