Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ব্যবসা বাঁচাতে কার্ডে দাম নিচ্ছে পাড়ার দোকানও

এক দিকে নোটের হাহাকার, অন্য দিকে প্লাস্টিক মানির ব্যবহার বাড়িয়ে দেশকে ‘ক্যাশলেস’ করার চেষ্টা। এই দুইয়ের মাঝখানে কার্যত ব্যবসা গোটাতে বসেছে শহরের গলিঘুঁজির ছোট ছোট মুদির দোকান।

বসল কার্ড সোয়াইপ যন্ত্র। দমদমের এক মুদি দোকানে। — নিজস্ব চিত্র

বসল কার্ড সোয়াইপ যন্ত্র। দমদমের এক মুদি দোকানে। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:২৪
Share: Save:

এক দিকে নোটের হাহাকার, অন্য দিকে প্লাস্টিক মানির ব্যবহার বাড়িয়ে দেশকে ‘ক্যাশলেস’ করার চেষ্টা। এই দুইয়ের মাঝখানে কার্যত ব্যবসা গোটাতে বসেছে শহরের গলিঘুঁজির ছোট ছোট মুদির দোকান। গত মাসের গোড়ার দিকে আচমকা নোট বাতিলের পরে এক ধাক্কায় বেশ চোট খেয়েছিল ব্যবসা। তার পর অনেকগুলো দিন পেরিয়েছে, হাজির হয়েছে মধ্যবিত্ত সংসারের বহু আকাঙ্ক্ষিত সময়, ‘মাস পয়লা’! কিন্তু পরিস্থিতি ভাল হওয়া দূরে থাক, বরং আরও খারাপ হয়েছে।

যেমন দমদমের নাগেরবাজার এলাকা। প্রতি মাসের গোড়ায় যে সব মুদি দোকানে মাসকাবারির তালিকা নিয়ে ভিড় জমান ক্রেতারা, সে সব দোকান আজ ফাঁকা। কারণ ক্রেতারা হয় ব্যাঙ্কের লাইনে, কিংবা হাতে দু’হাজারি নোট নিয়ে দিশাহারা হয়ে ঘুরছেন। কয়েক জন খদ্দের এলেও কোনও রকমে জরুরি কিছু জিনিস কিনেই ক্ষান্ত হচ্ছেন। মাসকাবারির বড় খরচে যাচ্ছেন না। কেন? নাগেরবাজারের সঞ্চিতা বিশ্বাস বললেন, ‘‘অ্যাকাউন্টে টাকা থাকলেও, হাতে নেই। তাই কয়েকটা জিনিস কিনে চলে যাচ্ছি। ফের ব্যাঙ্কে লাইন দেব। রোজকার কেনাকাটা তো কার্ডে সম্ভব নয়!’’

গোরাবাজার, দমদম-সহ পাড়ার ছোট ছোট মুদির দোকানগুলোতেও খদ্দের নেই। দোকানদারদের দাবি, ব্যবসা অর্ধেকেরও কম হয়ে গিয়েছে। মাসের প্রথমেও খদ্দের হাতে গোনা! এই পরিস্থিতিতে গোরাবাজারের একটি মাঝারি মুদি-দোকানে কার্ড সোয়াইপ করার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সাধারণত মাসের প্রথমে সেখানে অনেকেই লম্বা ফর্দ আর ব্যাগ রেখে বাড়ি চলে যান। পরে সময় মতো এসে ব্যাগভর্তি মাসকাবারি জিনিস নিয়ে যান। দোকানের মালিক গোবিন্দচন্দ্র সাহা জানালেন, অধিকাংশ মানুষের হাতেই এখন দু’হাজার টাকার নোট। সকলের পক্ষে বেশি টাকার জিনিস কেনা সম্ভবও নয়। তেমনই কম টাকার জিনিস কিনলে ব্যবসায়ীর পক্ষেও অত বড় নোট ভাঙিয়ে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তাই কার্ড-পরিষেবায় ভাল সাড়া পেয়েছেন গোবিন্দবাবু। ‘সার্ভিস চার্জ’ বাবদ ক্রেতাদের অবশ্য ১ শতাংশ অতিরিক্ত দাম গুনতে হচ্ছে।

টাকা ভাঙানোর সমস্যায় জেরবার ওই অঞ্চলের আরও একটি মুদি দোকানে গিয়ে দেখা গেল, খদ্দের নেই সেখানেও। সমস্যা সেই দু’হাজারি নোট। অনেকেই তিন-চারশো টাকার জিনিস কিনে গোলাপি নোট দেখাচ্ছেন। ভাঙানির অভাবে ফিরে যেতে হচ্ছে। দোকানের মালিক অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, গত কয়েক দিনে ব্যবসা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। মাসের পয়লা তারিখেও খদ্দের নেই। এই অবস্থায় কোনও খদ্দের বেশি টাকার জিনিস কিনলে অশোকবাবু চেকে পেমেন্ট নিচ্ছেন।

দক্ষিণ কলকাতার লেক গার্ডেন্স এলাকায় দোকান ভরা পসরা নিয়ে কার্যত চুপচাপ বসে রয়েছেন অনেকে। সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দুলাল ঘোষ বললেন, ‘‘বাজারের ছোট মুদির দোকানে ক্রেতা অনেক কমে গিয়েছে। আমাদেরও পাইকারি বাজার থেকে নতুন জিনিস কেনা সম্ভব হচ্ছে না।’’ কার্ড-ব্যবস্থা বা পেটিএম চালু করা সম্ভব নয়? দুলালবাবু জানান, তাঁর দোকানে কার্ড সোয়াইপ মেশিন থাকলেও অন্য ছোট দোকানগুলিতে এ ধরনের পরিকাঠামো নেই। এলাকার এক প্রসাধনী বিক্রেতা সঞ্জয় সর্দার বলেন, ‘‘কোনও ভাবে চালাচ্ছি। তবে মানুষের হাতে একেবারেই টাকা নেই। পেটিএম হয়তো করতেই হবে।

বাঁশদ্রোণী সুপার মার্কেটের একটি মুদির দোকানে আবার বোর্ড ঝুলছে— ‘‘সাতশো বা তার বেশি টাকার কেনাকাটা করলে ক্রেডি়ট এবং ডেবিট কার্ড ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।’’ সাতশো কেন? দোকানের মালিক সুব্রত পাল বলেন, ‘‘কার্ডের জন্য একটা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। সাতশো টাকার কম কেনাকাটা হলে ওই খরচ পোষাবে না।’’ তাঁর দাবি, এ বার মাস পয়লায় অন্য বারের তুলনায় অর্ধেক বিক্রি হচ্ছে। যার অন্যতম কারণ, নোটের সমস্যায় অনেক ক্রেতাই শপিং মলে বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ছুটছেন।

রানিকুঠির এক ব্যবসায়ী চিত্তরঞ্জন ঘোষ আবার ধার-বাকিতেই ব্যবসা টানছেন। বললেন, ‘‘এলাকার বহু চেনা লোক আমার দোকান থেকে মাসকাবারি জিনিস কেনেন। তাঁদের বলেছি জিনিস নিয়ে যান, পরে সুবিধে মতো দাম দেবেন। তবে বিক্রি অনেক কমেছে।’’ ক্রেতাদের জন্য পেটিএম, কার্ডের ব্যবস্থা করলেন না কেন? চিত্তবাবু জানান, দোকানে এক জন মাত্র কর্মচারীই এ সবের ব্যবহার জানেন। তাই তিনি ওই পথে যাননি।

আর নগদের এই হাহাকারে বহু ক্রেতাই কার্ড হাতে ছুটছেন শপিং মলে। যেখানে চাল-ডাল-মশলা-সব্জি— সবই এক ছাদের তলায়। নির্ঝঞ্ঝাটে কার্ডে মিটিয়ে দেওয়া যায় দাম। বেহালা সোদপুরের রত্না মুখোপাধ্যায় জানালেন, এত দিন পাড়ার দোকান থেকেই সব কিনতেন। কিন্তু এ বার হাতে নগদ এত কম, বাধ্য হয়ে কার্ড হাতে কাছের একটি ডিকার্টমেন্টাল স্টোরের দ্বারস্থ হয়েছেন।

একটি ছোট মুদির দোকানের ব্যবসায়ী অশোক সাউ জানালেন, ব্যবসা তো মার খাচ্ছেই। কিন্তু কার্ড বা পেটিএম করলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, তা নয়। আবার এ সবের বাড়বাড়ন্তে যে ব্যবসা উঠে যাবে, তা-ও নয়,। তাঁর দাবি, ‘‘যতই শপিং মল থাকুক, কার্ড থাকুক, পেটিএম থাকুক, রান্না করতে করতে হঠাৎ মশলা ফুরিয়ে গেলে মানুষ আমাদের দোকানেই ছুটে আসবেন হাতে খুচরো হাতে নিয়ে। বাড়িতে হঠাৎ অতিথি এলে, ডিম কিনতে আসতে হবে আমাদের কাছেই। প্রয়োজনে বাকিতে কিনবেন। কিন্তু মল পর্যন্ত যাবেন না।’’

ব্যবসার আকালে মাথায় হাত মুচিপাড়ার মুদি দোকানি কমল পালের। ‘‘এ ভাবে চললে ছোট ব্যবসা বলে কিছু থাকবে না আর। যারা অনলাইন পরিষেবার মুখ দেখেননি, হাতে নগদ না থাকায় তাঁরাও বাধ্য হয়ে সে দিকেই ঝুঁকছেন। আমাদের মতো দোকানগুলো তো এ বার তুলে দিতে হবে তা হলে!’’ বলছেন তিনি

তবে ধারাপাড়া এলাকার আর এক ব্যবসায়ী শঙ্কু সামন্তের সাফ কথা, ‘‘সরকারের সঙ্গে তো লড়াই করে পারব না। যেমন পরিস্থিতি আসবে, তেমন ভাবেই ব্যবসাটাকে বাঁচাতে হবে। তবে এই মুহূর্তে বড়সড় ক্ষতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।’’

তবে শপিং মলের বাড়বাড়ন্ত দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত সিরিটির প্রবীণ ব্যবসায়ী নিমাই শেঠ। ‘‘এক দিকে মানুষের হাতে টাকা কমে গিয়েছে, অন্য দিকে নিত্যনতুন আকর্ষণীয় অফারে ক্রেতাদের বড় অংশকে টেনে রাখছে শপিং মলগুলো। আমরা কোথায় যাব!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cashless marketing Small shop
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE