লেলিহান। শনিবার ভোরে, হাওড়ার কদমতলা বাজারে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে গেল হাওড়ার কদমতলা বাজার। পুজোর ঠিক মুখেই প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো এই বাজারটি পুড়ে যাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে সেখানকার ব্যবসায়ীদের। দমকলের ১০টি ইঞ্জিন প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে পুজোর বিকিকিনির জন্য মজুত করা কয়েক লক্ষ টাকার জিনিসপত্র। আগুন নেভানোর কাজে সাহায্য করতে গিয়ে এক ব্যবসায়ীও জখমও হয়েছেন। সুনীল পাল নামে ওই ব্যক্তিকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
মধ্য হাওড়ার ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় প্রায় ২০ বিঘে জায়গায় গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ওই বাজারে সব্জি ও মাছের বহু দোকান ছাড়াও রয়েছে মুদিখানা-সহ আরও ৬০-৭০টি দোকান ও গুদাম। যার মধ্যে অধিকাংশই তৈরি হয়েছে বাঁশ, কাঠ, ত্রিপল বা প্লাস্টিক দিয়ে। দমকল সূত্রের খবর, ওই বাজারে ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও ছিল না। আগুন লাগার পরে দমকলকে বাজার থেকে বেশ কিছুটা দূরের একটি পুকুর থেকে পাম্প লাগিয়ে ‘রিলে’ পদ্ধতিতে জল নিয়ে আসতে হয়। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ঘিঞ্জি এলাকার ঠিক মাঝখানে এত দিন ধরে অগ্নিবিধি না মেনেই বাজার চললেও পুরসভা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি কেন? কেনই বা সতর্ক করা হয়নি ব্যবসায়ীদের?
অগ্নিকাণ্ডের পরে হাওড়া পুরসভার পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাহায্যে প্রাথমিক ভাবে ১০ লক্ষ টাকা অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি, বাজারটি ফের যাতে দ্রুত বসতে পারে, সে জন্য পরিকাঠামোগত সমস্ত সাহায্যের দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। মেয়র রথীন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বাজারটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। তা ছাড়া, ওই সম্পত্তি নিয়ে অনেক শরিকি মামলা রয়েছে। আমরা বারবার মালিকদের চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কিছু হয়নি। এ বার কড়া হাতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে পুরসভা মালিকদের বিরুদ্ধে এফআইআর করবে।’’
দমকল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার ভোর সওয়া পাঁচটা নাগাদ প্রথম আগুনের ফুলকি দেখা যায় বাজারের ঠিক মাঝখানে একটি দশকর্ম ভাণ্ডারে। তখন সবে বাজারে আনাজপত্র নিয়ে বিক্রেতারা আসতে শুরু করেছেন। তাঁরাই প্রথম আগুন দেখতে পেয়ে বাজারের ঠিক উল্টো দিকে ব্যাঁটরা থানায় খবর দেন। থানা থেকে খবর দেওয়া হয় দমকলে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রথমে দমকলের তিনটি ইঞ্জিন আসে। তা-ও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে। তার মধ্যেই অবশ্য আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা দুটো ভাতের হোটেলে। অভিযোগ, ওই হোটেলগুলির পাশে আর একটি দোকানঘরে মজুত রাখা কেরোসিনেও আগুন লেগে গিয়ে তা দ্রুত বাজারে পূর্ব দিক গ্রাস করে নেয়।
সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কালো ধোঁয়ায় গোটা এলাকা ভরে গিয়েছে। দাউদাউ করে জ্বলছে বাঁশ, কাঠ দিয়ে তৈরি টিন বা টালির চালের ঘরগুলি। চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে আলু-পেঁয়াজের পোড়া বস্তা। আগুন নেভাতে দমকলের সঙ্গে দোকানি ও তাঁদের কর্মীরাও হাত লাগিয়েছেন। খবর পেয়ে দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছন হাওড়া পুরসভার তিন জন মেয়র পারিষদ— দিব্যেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র ও বিভাস হাজরা। দিব্যেন্দুবাবু জানিয়েছেন, এই বাজারটি নিয়ে শরিকি বিবাদ রয়েছে। মামলা-মোকদ্দমা চলছে। তাই পুরসভা মালিকদের চিঠি দিলেও কোনও কাজ হয়নি। পরে ঘটনাস্থলে আসেন সমবায়মন্ত্রী ও মধ্য হাওড়ার বিধায়ক অরূপ রায় ও মেয়র রথীন চক্রবর্তী।
এক মুদির দোকানের মালিক মহাবীর সাউ বলেন, ‘‘পুজোর জন্য প্রায় ১০ লক্ষ টাকার মাল মজুত করেছিলাম। সব শেষ হয়ে গেল। এর পরে তো পরিবার নিয়ে আমাকে পথে বসতে হবে।’’ একই অবস্থা অরুণ সাউ, প্রতিমা মণ্ডলদের। সকলেরই বক্তব্য, পুজোর আগে তাঁদের আয়ের পথটাই বন্ধ হয়ে গেল। কবে ফের বাজার বসবে, কেউ জানেন না। হাওড়ার তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ব্যবসায়ীর সাহায্য করতে তিনি তাঁর সাংসদ তহবিল থেকে দশ লক্ষ টাকা দেবেন।
কদমতলা ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ শুভাশিস কুণ্ডু বলেন, ‘‘এর আগে এই বাজারে কোনও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেনি। ঠিক কী ভাবে আগুন লাগল, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে বাজার যাতে দ্রুত বসতে পারে, সে জন্য মালিক ও পুরসভার কাছে আমরা সাহায্য চাইব।’’ তা তবে ব্যবসায়ীদের অধিকাংশের অভিযোগ, দমকল শুধু দেরিতে আসেনি, ইঞ্জিনের সংখ্যাও প্রথম দিকে কম ছিল। তাই আগুন এত বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিল।
ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ অবশ্য মানতে রাজি নন দমকলের হাওড়ার ডিভিশনাল অফিসার অভিজিৎ পাণ্ডে। তিনি বলেন, ‘‘খবর পাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে আমাদের তিনটি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে দিয়েছিল। পরে আরও ইঞ্জিন আসে। কদমতলার ওই বাজারে বাঁশ ও প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থে তৈরি প্রচুর অস্থায়ী কাঠামো থাকায় আগুন এতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy