Advertisement
০১ মে ২০২৪
শহরে সাইকো শিহরন

কঙ্কাল দেখিয়ে পার্থ বললেন, ওই তো দিদি শুয়ে

ঘরে ঢুকতেই পুলিশের চোখে পড়ল ব্যাপারটা। খাটের পাশে বেঞ্চে শোয়ানো রয়েছে কম্বলঢাকা একটি নরকঙ্কাল! তার গায়ে তখনও শীতের পোশাক। পাশে ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর শুকনো ফল, পচা পাস্তা, পিৎজা, ভাত। ঘরের ভিতরে দাঁড়ানো এক মাঝবয়সী ব্যক্তি কঙ্কালটি দেখিয়ে বললেন, ‘‘ওই তো আমার দিদি শুয়ে আছে!’’ দিদি একা নন, দিদির পোষ্যরাও আছে। মেঝেতে পড়ে রয়েছে দু’টি কুকুরের কঙ্কাল!

রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়ির অন্দরমহল। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়ির অন্দরমহল। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

শিবাজী দে সরকার
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০৩:১৩
Share: Save:

ঘরে ঢুকতেই পুলিশের চোখে পড়ল ব্যাপারটা। খাটের পাশে বেঞ্চে শোয়ানো রয়েছে কম্বলঢাকা একটি নরকঙ্কাল! তার গায়ে তখনও শীতের পোশাক। পাশে ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর শুকনো ফল, পচা পাস্তা, পিৎজা, ভাত।

ঘরের ভিতরে দাঁড়ানো এক মাঝবয়সী ব্যক্তি কঙ্কালটি দেখিয়ে বললেন, ‘‘ওই তো আমার দিদি শুয়ে আছে!’’

দিদি একা নন, দিদির পোষ্যরাও আছে। মেঝেতে পড়ে রয়েছে দু’টি কুকুরের কঙ্কাল!

বৃহস্পতিবার তিন নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে ওই দৃশ্য দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলেন শেক্সপিয়র সরণি থানার দুঁদে পুলিশ অফিসারেরা। ঠিক যেন আলফ্রেড হিচককের ছবির কোনও হাড় হিম করা দৃশ্য। ‘সাইকো’ ছবির মোটেল মালিক তো অনেকটা এ ভাবেই মায়ের দেহ কবর থেকে খুঁড়ে বার করে পরচুলা, পোশাকে সাজিয়ে বিছানায় শুইয়ে বা চেয়ারে বসিয়ে রাখতেন। নিজের মায়ের মতো সেজে পরপর খুন করতেন সেই মোটেল মালিক। আর ভাবতেন— তিনি নয়, তাঁর মা-ই ওই সব খুন করেছেন।

রবিনসন স্ট্রিটে এখনও পর্যন্ত কোনও খুনের প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু মাসের পর মাস প্রিয় দিদি ও দুই পোষা কুকুরের কঙ্কালের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছিলেন পার্থ দে নামে মধ্য চল্লিশের এক যুবক। সঙ্গী ছিলেন তাঁর বাবা অরবিন্দ দে-ও। পার্থর বয়ান অনুযায়ী, গত বছর অগস্টে মারা গিয়েছিল তাঁদের পোষ্য দু’টি ল্যাব্রাডর কুকুর। সেগুলির দেহ ঘরের ভিতরেই রেখে দিয়েছিলেন পার্থ এবং তাঁর দিদি দেবযানী। বাধা দেননি বাবা অরবিন্দবাবুও। কিন্তু কুকুরের শোক ক্রমশ গ্রাস করে দেবযানীকে। তিনি খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ করে দেন। পার্থর দাবি, গত ডিসেম্বরে মারা যান দেবযানী (৪৬)। এ বার পার্থ ও অরবিন্দ দেবযানীর মৃতদেহ আগলে রাখেন। এত দিন সে ভাবেই চলছিল। বুধবার রাতে ফ্ল্যাটের শৌচাগার থেকে উদ্ধার করা হয় অরবিন্দবাবুর (৭৭) অগ্নিদগ্ধ দেহ। এ দিন ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া একটি সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে পুলিশের দাবি, আত্মহত্যাই করেছেন অরবিন্দবাবু। পুলিশ জানিয়েছে, সুইসাইড নোটে ৮ জুন তারিখ দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘আমি নিজের ইচ্ছায় মৃত্যুবরণ করছি। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ঈশ্বর পার্থর ভাল করুন। পার্থ ভাল থেকো।— ভালবাসা বাবা।’’ পুলিশের সন্দেহ, অরবিন্দবাবুর দেহ উদ্ধার না হলে হয়তো তাঁর দেহটিও রেখে দিতেন পার্থ।

অর্থাৎ এই দে পরিবারে এক-একটি করে ম়ৃত্যুর ঘটনা ঘটে। জীবিতেরা তখন মৃতদের আঁকড়ে বাঁচা শুরু করেন। আবার একটা সময়ে জীবিতরা কেউ আত্মহননের পথে এগিয়ে যান। কঙ্কালের তালিকাও দীর্ঘ হয়। কী ব্যাখ্যা এই অদ্ভুত পরম্পরার? মনোবিদেরা বলছেন, এটা এক ধরনের মানসিক অসুখ, যেখানে কোনও ভ্রান্ত ধারণাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান অনেকে। মনস্তত্ত্ববিদদের একাংশের মতে, এক অস্বাভাবিক একাত্মতাবোধ থেকেও এমনটা হতে পারে। কিন্তু একটি পরিবারের এত জন একসঙ্গে এমন রোগাক্রান্ত হলেন কী ভাবে?

প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, অরবিন্দবাবু বেঙ্গালুরুর একটি সংস্থার উচ্চপদে চাকরি করতেন। রবিনসন স্ট্রিটের এই বাড়ির দীর্ঘদিনের বাসিন্দা তাঁরা। এক সময় শহরের একটি অভিজাত ক্লাবে নিয়মিত গল্‌ফ খেলতেন তিনি। ২০০৫ সালে অরবিন্দবাবুর স্ত্রী আরতিদেবী মারা যান। তার পর থেকেই সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দে পরিবার। অস্বাভাবিক আচরণের শুরুও সম্ভবত তার পর থেকেই। দেবযানী ও পার্থ, দু’জনেই ই়ঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলেন। নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজের সূত্রে পার্থ এক সময় আমেরিকাতেও থাকতেন। দেবযানী কলকাতার দু’টি নামী স্কুলে সঙ্গীতের শিক্ষকতা করতেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু আরতিদেবী মারা যাওয়ার পর ২০০৭ সালে ভাইবোন দু’জনেই চাকরি ছেড়ে দেন। তার পর থেকে বাড়িতেই থাকতেন তাঁরা। বিয়ে করেননি কেউই। পুলিশের কাছে পার্থর দাবি, চাকরিতে পোস্টিং নিয়ে গোলমাল হওয়ায় তিনি চাকরি ছাড়েন। দিদিই ছিলেন তাঁর সব থেকে প্রিয় বন্ধু। তাই মৃত্যুর পরে দিদিকে কাছছাড়া করতে চাননি তিনি। দিদিকে রাতে নিয়মিত খেতে দিতেন। ‘সন্তানতুল্য’ কুকুরদেরও কাছে রেখেছিলেন। খাবার দেওয়া হতো তাদের কঙ্কালকেও।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন

কী ভাবে জট খুলল এত ঘটনার?

পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার রাত সাড়ে আটটার সময় প্রথমে শৌচাগার থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেন বাড়ির এক নিরাপত্তারক্ষী। তিনি খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন, পার্থ ঘরের বাইরে উঁকি দিচ্ছেন। রক্ষীর চিৎকার শুনে পাশের বাড়ি থেকে পার্থর কাকা ও তাঁর পরিবারের লোকেরা ছুটে আসেন। কিন্তু পার্থ তাঁদের ঘরে ঢুকতে দেননি। এর পরে দমকল এবং পুলিশে খবর যায়। দমকল পৌঁছে প্রথমে শৌচাগারের দরজা ভেঙে বাথটবের ভিতর থেকে অরবিন্দবাবুর দগ্ধ দেহ উদ্ধার করে। তার পরে পুলিশ পৌঁছয়।

পুলিশ সূত্রের খবর, অরবিন্দবাবু দেহ উদ্ধার করার পর পার্থর আচরণ স্বাভাবিক ছিল না। সে কারণে রাতে ওই ঘরে দু’জন কনস্টেবলকে পাহারায় বসানো হয়েছিল। রাতে পার্থ হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করা শুরু করেন। ইতস্তত ছুটতে থাকেন, দেওয়ালে গিয়ে মাথাও ঠুকতে থাকেন। এ দিন সকালে সেই খবর পেয়ে থানার ওসি-সহ অফিসারেরা আসেন। পার্থ তখন তাঁদের বলেন, তিনি কোনও আশ্রমে যেতে চান। সেখানে গিয়ে তিনি কিছু কবুল করবেন। এর পরে পুলিশ তাঁকে মাদার হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে পার্থ বলেন, ‘‘আমি এমন কিছু করেছি, যা আইনের চোখে অপরাধ। আশা করি, আমার আবেগ বুঝতে পারবেন।’’

পুলিশ তখনও ভাবছিল, পার্থ হয়তো বলবেন, বাবাকে তিনি খুন করেছেন। কিন্তু পার্থ তাঁদের অবাক করে দিয়ে জানান, তাঁর দিদি ছ’মাস আগে মারা গিয়েছেন। কিন্তু তিনি দিদিকে এখনও নিজের ঘরেই রেখে দিয়েছেন। এর পরই পুলিশ গিয়ে কঙ্কালগুলি আবিষ্কার করে। লালবাজারের প্রবীণ অফিসারদের অনেকেই বলছেন, প্রিয়জনের মৃত্যুর পর দেহ আগলে বসে থাকার গুটিকতক ঘটনা এর আগে দেখা গিয়েছে। কিন্তু দেহ আগলে রেখে কঙ্কালে পরিণত করে ফেলার ঘটনা শহরে বিরল। ঘটনাস্থলে আসেন এসএসকেএম হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান বিশ্বনাথ কাহালি। তিনি বলেন, ‘‘কঙ্কালের ময়নাতদন্তের পরই মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।’’

এ ক্ষেত্রে অবশ্য একটা সন্দেহের কাঁটা খচখচ করছে। কারণ ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্র ছ’মাসে কোনও দেহ কঙ্কালে পরিণত হতে পারে না! কঙ্কালটি কত দিনের পুরনো, এখন তা যাচাই করাচ্ছে পুলিশ। কঙ্কালটি আদৌ দেবযানীর কি না, পরীক্ষা করা হবে তা-ও। দেবযানীর মৃত্যুর কথা তাঁর বাবা ও ভাই ছাড়া আর কেউ জানতে পারেননি কেন, সে প্রশ্নও উঠেছে। বাড়ির এক পাশে ছিল পার্থর ঘর। জানলার পাশে গাছ এবং বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ঘরটি তল্লাশি করে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ঘরে বাতানুকূল যন্ত্র বসানো ছিল। জানলা-দরজার ফাঁক বন্ধ করে হাওয়া চলাচলও পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন পার্থ। ঘরে কাউকে ঢুকতে দিতেন না। পাড়ায় মেশামেশিও তেমন ছিল না। দৈবাৎ লোকজন এলে বসার ঘর কিংবা সরাসরি বাবার ঘরে নিয়ে যেতেন তিনি। পার্থকে জেরা করে পুলিশের ধারণা হয়েছে, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। আদালতের মাধ্যমে তাঁকে আপাতত গোবরা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, দেবযানীর কঙ্কালের পাশে বিভিন্ন ছোট চিরকুটে লেখা কিছু প্রশ্ন, বাটিভর্তি কয়েন মিলেছে। এ সব থেকে পুলিশের অনুমান, পার্থ হয়তো মৃতদেহ নিয়ে প্ল্যানচেটও করতেন।

এ দিন সকালে পার্থর ফ্ল্যাটে ঢুকে চমকে গিয়েছিলেন ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা। হঠাৎই তাঁর কানে আসে, কোথাও থেকে এক মহিলার গলা ভেসে আসছে। খতিয়ে দেখতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, ফ্ল্যাটের বিভিন্ন ঘরে স্পিকার লাগানো রয়েছে। তাতেই ওই মহিলার গলা শোনা যাচ্ছে। এ দিন সকালে এক বিদেশি মহিলার আধ্যাত্মিক বাণী চালানো ছিল ওই সব স্পিকারে। উদ্ধার করা পেন ড্রাইভে আমেরিকান অ্যাভেঞ্জারিস্টের গান ছিল, যাতে ভৌতিক মন্ত্র আওড়ানো হতো। বাথরুমেও লাগানো ছিল সাউন্ড সিস্টেম।

পার্থর ঘর থেকে দেবযানীর কথা, গানের ভয়েস রেকর্ডিংও মিলেছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। মিলেছে ৬টি ডেস্কটপ ও ২টি ল্যাপটপ। অরবিন্দবাবুর ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কয়েক হাজার বই। উদ্ধার করা হয়েছে প্রচুর বাদ্যযন্ত্রও। পার্থর লেখা একটি খাতাও উদ্ধার করা হয়েছে। তার উপরে ‘মাই স্টোরি, মাই লাইফ’ কথাটি লেখা রয়েছে। ভিতরে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘রবিনসন স্ট্রিট এক সময় সাজানো বাগান ছিল। কিন্তু কারও বিষ নজর পড়েছে। তাই শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার মাকেও টেনে নিয়েছে ওই বিষ নজর।’’ ওই খাতায় তাঁর মায়ের মৃত্যুর জন্য পরিবারের এক সদস্যকেও দায়ী করেছেন পার্থ।

শুধু পার্থবাবু নন, অরবিন্দবাবুর মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তদন্তকারীরা। তাঁরা বলছেন, দেবযানীর দেহ সংরক্ষণের কথা জানতেন অরবিন্দবাবুও। গত ১১ মে পার্থর জন্মদিন উপলক্ষে ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন তাঁর কাকা অরুণ দে ও কাকিমা মুক্তি দে। তখন দেবযানী কোথায় জানতে চাইলে পার্থ বলেন, ‘‘দিদি একটি হোমে গিয়েছে।’’ তাতে সম্মতি জানিয়েছিলেন অরবিন্দবাবুও। এর আগেও দেবযানীর ব্যাপারে পার্থ একই কথা বলেছিলেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE