স্রোতের বিরুদ্ধে: রিকশা নিয়ে পথে ঝুমা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
ভরা স্ট্যান্ডে একটি রিকশার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন তরুণী। সওয়ারি হিসেবে নয়, চালক হিসেবেই। কিন্তু কেউই চড়ছেন না সে রিকশায়। যদি বা কেউ এগোচ্ছেন, অন্য রিকশাওয়ালারা বাধা দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, ‘‘ওটা লাইনের রিকশা নয়, উঠবেন না।’’ তবু তরুণী নড়েন না। দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করে চলেছেন।
বছর খানেক আগের শুরুটা এমনই ছিল। বছর পঁচিশের ঝুমা জানতেন, সিদ্ধান্তটা সহজ নয়। ছোটবেলা থেকে ঘা খেতে খেতে বড় হওয়া এবং ছোট্ট দুই সন্তানের মা ঝুমা এ-ও জানতেন, এই সময়ে সসম্মান জীবনযাপন করে পরিবারকে বাঁচানোর পথ সহজ হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু এই কঠিন পথই সহজ হয়ে গিয়েছে বছর খানেকের চেষ্টায়। এক জন-দু’জন করে সওয়ারি এক রকম জোর করেই উঠতে শুরু করেন ঝুমার রিকশায়। এক দিন এলাকার কাউন্সিলর রাজীব দাসও রিকশা চালাতে দেখেন ঝুমাকে। সব জেনে তিনিই ঝুমাকে রিকশা নিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দেন। শীলপাড়া এলাকার পোড়া অশ্বত্থতলা রিকশা স্ট্যান্ডের চালকদের মধ্যে ঝুমা এখন বেশ পরিচিত মুখ।
শীলপাড়ার রামকৃষ্ণ নগরের ছোট্ট এক কামরার ইটের বাড়িতে ভাড়া থাকেন ঝুমা। ঘরের ভিতরে একটা তক্তপোশ রাখার পরে কার্যত পা ফেলারই জায়গা নেই। টিমটিম করে জ্বলছে হলদে আলো। তাতেই বই খুলে পড়তে বসেছে ঝুমার ন’বছরের ছেলে সূর্য। ঘরের সামনে সরু গলি জুড়ে নাগাড়ে দুষ্টুমি করে চলেছে মেয়ে, তিন বছরের সৃষ্টি।
মাত্র তেরো বছর বয়সে উত্তরপ্রদেশের এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় ঝুমার। সে বিয়ে ভেঙেও যায় কয়েক বছরের মধ্যে। তত দিনে ঝুমার কোলে এসে গিয়েছে সূর্য। পরে ফের বিয়ে করেন বরুণ পণ্ডিত নামের এক গাড়িচালককে। ‘‘নেশাই ওকে শেষ করে দিল, জানেন। না
হলে বিয়ের সময়ে ও যখন ড্রাইভার ছিল, তখন সব ঠিকই ছিল। নেশা করে গাড়ি চালাতে গিয়ে, একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে লাইসেন্স খোয়াল। তার পর থেকেই শুরু অশান্তি,’’ বলছিলেন ঝুমা। সংসার চালাতে আশপাশের বাড়িতে ঠিকে কাজ করতেন ঝুমা। ভোরবেলা বাজারে আনাজও বিক্রি করতেন। দ্বিতীয় সন্তান সৃষ্টিও তত দিনে এসেছে কোলে।
কিন্তু ঝুমা ক্রমেই বুঝতে পারছিলেন, তাঁর খাটনির রোজগারে শুধুই নেশা করছেন বেকার স্বামী। পয়সা জমিয়ে কিনে ফেলেন একটি রিকশা। এক রকম জোর করেই স্বামীকে বাধ্য করেন চালাতে। কিন্তু ঝুমা বলেন, ‘‘এক দিন চালালে তিন দিন চালায় না সে। পকেটে টাকা এলেই নেশা আরও বেড়ে যায়। এ ভাবে সংসার চলে! বাধ্য হয়েই আমি বেরোতে শুরু করি। লোকের বাড়ি কাজ করার থেকে আমার বেশি ভাল লাগে রিকশা চালাতে।’’
এখান থেকেই শুরু গোলমালের। এত দিন রোজগার না করে এবং লাগাতার নেশা করে যে স্বামীর সম্মানে আঁচড় পড়েনি, স্ত্রী রিকশার প্যাডেলে চাপ দিতেই সে সম্মান খানখান হয়ে গেল। বাড়ি ছেড়ে চলেই গেলেন তিনি।
এখন হাঁফ ছাড়ার অবকাশ নেই ঝুমার। ভোর ভোর উঠে ছেলেমেয়েকে তৈরি করে স্কুলে পাঠান তিনি। সামলে নেন রান্নাবান্না, ঘরকন্নার কাজও। আটটার মধ্যেই পৌঁছে যান স্ট্যান্ডে। চলতে থাকে একের পর এক ট্রিপ। পোড়া অশ্বত্থতলা থেকে খালপাড়। সাড়ে এগারোটা নাগাদ ছেলেমেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে নিজের রিকশায় চাপিয়েই ফেরেন ঘরে। ফিরতে ফিরতেই শুনে নেন, সারা দিন কী কী হল স্কুলে। স্নান-খাওয়া সেরে, ছেলেমেয়েকে শুইয়ে, দুপুর গড়াতেই ফের স্ট্যান্ডে। সূর্য-সৃষ্টি নিজেরাই খেলতে যায়, পড়তেও বসে। ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায় ঝুমার। ক্লান্তিতে ভেঙে আসে শরীর।
এই রিকশা চালানোর ‘অপমানে’ ঝুমাকে এক রকম ত্যাগ করেছে তাঁর নিজের পরিবারও। সকলের একটাই কথা— মেয়ে হয়ে রিকশা চালাবে! ‘‘এই কথাটা যে কত বার, কত জনের কাছ থেকে, কত রকম ভাবে শুনেছি আমি...!’’ বস্তুত, তথাকথিত ‘পুরুষের কাজ’ কোনও মেয়ে
সফল ভাবে তাল মিলিয়েছে, এটা আজও মেনে নিতে পারে না সমাজের বেশির ভাগটাই। এ কথা আলোচনা করতে গিয়ে ছিটকে এল ঝুমার প্রশ্ন, ‘‘কিন্তু মেয়েরা তো এরোপ্লেনও চালাচ্ছেন, আমি রিকশা চালালে সমস্যা কী?’’
সূর্যকে ভাল কোনও আবাসিক স্কুলে রেখে পড়াবেন, স্বপ্ন ঝুমার। দৈনিক ২০০-৩০০ টাকার আয় সে স্বপ্নকে খুব একটা আলো দেখায় না অবশ্য। আয় বাড়ানোরও তেমন কোনও উপায় নেই। পুরুষ যাত্রীরা এখনও সে ভাবে ওঠেন না ঝুমার রিকশায়। তাঁদের ‘সম্মানে’ লাগে। প্রায়ই ‘মেয়েছেলের’ বাড়াবাড়িতে নিজেদের সম্মান যাওয়ার অভিযোগ তোলেন স্ট্যান্ডের অন্য পুরুষ চালকেরাও।
ছেলেকে প়ড়তে বসিয়ে, মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে হাসিমুখে ঝুমার উত্তর, ‘‘ওঁদের সম্মান দিয়ে তো আমার সংসারটা চলে না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy