ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
প্রাচুর্য ও বিলাসিতায় এর সঙ্গে টেক্কা দেওয়া মুশকিল। প্রমোদতরণীর সংজ্ঞাটাও হয়তো বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এমনই বিলাসবহুল প্রমোদতরণী চালু হল এবার হুগলী নদীতে। একটি বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে শহরে এল মোটর চালিত বৃহৎ প্রমোদতরণী। যার গতি এবং বিলাস সম্ভার প্রচলিত জলবাহনগুলোর থেকে অনেকটাই আলাদা।
গঙ্গায় যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে অনেককাল ধরেই নৌকা ফেরি বা বজরা দেখেই অভ্যস্থ কলকাতাবাসী। এবার এই চেনা ছবিরই নাকি বদল দেখবে শহরবাসী এমনটাই দাবী সংস্থার।
এর আগেও এই গঙ্গাবক্ষে আরও তিনটি বিলাসবহুল প্রমোদতরণী চালু হয়েছে।
রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর দাবি, বিগত চার বছরে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছে। আর তার প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘‘ দেখুন ভিভাডা রোজ বুকিং থাকছে, বিদেশ থেকে পর্যটক আসছেন।’’ ভিভাডার মতো প্রমোদতরণীগুলো প্রায় আগামী দু’বছরের জন্য বুকিং করা আছে। কিন্তু এগুলো মূলত কলকাতা থেকে বারাণসী যাতাযাত করে। যা যেতে কমপক্ষে পনেরো দিন সময় লাগে। কলকাতায় বর্তমানে ব্যয়বহুল প্রমোদতরণীর সংখ্যা তিনটি। সুতরাং, সেক্ষেত্রেও খুব বেশি সংখ্যক পর্যটক যে আসছেন এমনটাও নয়।
ভিভাডার অধিকর্তা সুশীলা রামামূর্তি জানান, ‘‘এইসব প্রমোদতরণীতে পর্যটকেরা আসছেন সংস্থার নিজেদের উদ্যোগে। তাদের তিনটি প্রমোদতরণীর মধ্যে যেটা কলকাতা থেকে বারাণসী যায় সেটা তেই পর্যটকদের ভিড় থাকে। বিদেশ থেকে যেসব পর্যটকেরা কলকাতায় আসছেন, তাঁরা প্রমোদতরণীতে উঠছেন তাঁদের যাত্রাপথ জলপথে কলকাতা থেকে বারাণসী। তাঁরা মূলত উত্তর ভারত দেখতে যান। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা দেখতে তাঁরা আসেন না।’’ এছাড়াও তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন বানিজ্য মেলায় সংস্থা স্ব উদ্যোগে যায় ও পর্যটকদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘২০০৭ এ যখন এখানে ব্যবসা শুরু হয় তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলায় অংশগ্রহন করলেও, বিগত দু’বছরে সরকারী অংশগ্রহন কমেছে। পশ্চিমবঙ্গকে পর্যটনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের নিজেকে তুলে ধরা দরকার।’’
অনেকেরই দাবি, প্রমোদতরণীতে ভিড় হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে পর্যটন মন্ত্রী রাজ্যের পর্যটনের যে ‘অগ্রগতি’র কথা বলছেন তা আসলে সত্য নয়। রাজ্য পর্যটন দফতরের এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা নেই। রাজ্য প্রশাসনের এক অধিকর্তা জানান, রাজ্যের লাভ বলতে কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার জন্য রাজ্য সরকার কিছু কর আদায় করতে পারে মাত্র।
শহরে প্রচুর বিদেশী পর্যটক দেখা গেলেও তারা যে কলকাতা শহরটাকে দেখতে খুব একটা আগ্রহী নয় তার বেশ কিছু কারণ আছে বলে মনে করছেন বিভিন্ন মহল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যে শহরের আইন-শৃঙ্খলার রক্ষনাবেক্ষন নিয়ে রোজ প্রশ্ন উঠে সে শহর কখনই পর্যটকেদের কাছে আকর্ষনীয় হবেনা। তাছাড়াও, কলকাতা শহরের রাস্তার হাল বেহাল, যানজট এখানের নিত্যসঙ্গী, বর্ষাকালে রাস্তায় জল জমা তো এই শহরের চেনা ছবি। গাড়ি রাখারও পর্যাপ্ত জায়গার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাছাড়া দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর রক্ষনাবেক্ষন ঠিকমতো হয়না। কালীঘাট থেকে প্রিন্সেপ ঘাট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে দক্ষিনেশ্বর, চারিপাশের ছবিটা কিন্তু একই, নোংরা, আর আবাঞ্ছিত লোকজনের ভিড়। তাছাড়া হুগলী নদীর চারিপাশের ঘাটগুলোর অবস্থাও খুবই খারাপ। কোথাও জলে ভেসে আসা লাশের স্তুপ আবার কোথাও নোংরা আবর্জনায় ভর্তি। এই ‘সৌন্দর্য’ দেখতে কতখানি ইচ্ছুক পর্যটকেরা আর সেই শহর পর্যটকদের কাছে কতটা আকর্ষনীয় সেই নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় বলে মনে করছেন বিভিন্ন মহল।
পাশাপাশি এটাও অনেকেই মনে করছেন কলকাতায় আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থাকা সত্বেও যেহেতু ইউরোপ বা আমেরিকার সঙ্গে যাতায়াতের কোন সরাসরি বিমান পরিষেবার সুবিধা নেই, স্বাভাবিক ভাবেই বিদেশী পর্যটকদের এরাজ্যে আসার আকর্ষন তেমন নেই।
বিদেশী পর্যটকদের মুখেও শোনা গেল এই শহরকে দেখতে এসে তাঁরা নানা রকম সমস্যায় পরছেন। পর্যটকদের সুবিধার জন্য এই শহরে গাইডের কোন রকম ব্যবস্থা নেই, আর সেই সুযোগের ব্যবহার করছে বেশ কিছু চিটিংবাজ। আর অনেক সময়ই এইসব ‘ধান্দাবাজেদের’ কবলে পরছেন বিদেশ থেকে আসা পর্যটকেরা।
অতএব, যে শহরে পরিকাঠামোগত এতগুলো সমস্য থেকে গেছে, সেই শহরকে দেখতে বিদেশ থেকে বা অন্য রাজ্য থেকে পর্যটক আসতে আদৌও কতটা ইচ্ছুক সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। তাছাড়াও যেসব বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে ব্যয়বহুল প্রমোদতরণী চালু হচ্ছে, তাদেরও মুখে শোনা যাচ্ছে কলকাতার পরিকাঠামো না থাকার কথা। তাঁরা বলছেন, ‘‘এই শহরকে দেখতে আসার ইচ্ছে তেমনভাবে বিদেশী পর্যটকদের নেই। কারণ মৌলিক পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। মিলেনিয়াম পার্কের চারিপাশের রাস্তার ট্রাফিকের অবস্থা খুবই খারাপ। গাড়ি রাখারও জায়গা নেই, তাছাড়া, এইসব প্রমোদতরণীগুলো রক্ষনাবেক্ষনের জন্য যে ধরণের পরিশ্রুত জলের প্রয়োজন তারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে।’’
অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো যে রয়েছে, সে কথা মেনে নিলেন খোদ রাজ্য পরিবহন সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে এখনও সম্পূর্ণ পরিকাঠামো গড়ে উঠেনি, বিশেষত প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নতি খুব একটা হয়নি, প্রমোদতরণী রক্ষনাবেক্ষনেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। তবে তিনি এই অব্যবস্থার জন্য প্রশাসন ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যথাযত যোগাযোগের অভাবকেই দায়ী করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy