ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
মন্থর গতিতে এগিয়ে চলা টানা রিকশাটার পিছু নিয়েছে একদল স্কুল ফেরত কচিকাঁচা। অগ্রহায়ণের শেষ বেলায় রকের আড্ডায় মশগুল কিছু চেনা মুখ। দোতলা বারান্দার আলো–আঁধারির খেলায় খিড়কি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে আপন মনে চুল বাঁধতে ব্যস্ত এক গৃহবধূ। এরই মাঝে তীব্র গতির বাইকের আওয়াজে নিমেষেই স্বপ্নভঙ্গ। এটাই আমার পাড়া হিদারাম ব্যানার্জি লেন।
নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট থেকে শুরু করে রাস্তাটা মিশেছে শশিভূষণ দে স্ট্রিটে। পাশেই দুর্গা পিতুরি লেন। এক দিকে বাবুরাম শীল লেন, অন্য দিকে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট। আপাতদৃষ্টিতে ঝাঁ-চকচকে না হলেও এ পাড়ার আনাচে কানাচে আছে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ পাড়ায় পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, তবু চলার পথে আজও মেলে সাবেক কলকাতার ঝলক। পর পর বেশ কিছু ঔপনিবেশিক স্থাপত্য, তারই মাঝে হাল আমলের বাড়ি, বহুতল।
এ পাড়ায় বিপদে-আপদে এক ডাকেই পাশে পাওয়া যায় বহুদিনের প্রতিবেশীদের। আজও টিকে আছে তাঁদের বাড়িতে যাতায়াত, উৎসবে-অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করার রীতিটা। তবে যাঁরা নতুন এসেছেন, তাঁরা আবার নিজেদের মতো থাকতে পছন্দ করেন। সময়ের সঙ্গে অনেকটা মিলিয়ে গিয়েছে আড্ডার চেনা ছবিটাও। একে একে হারিয়ে গিয়েছে পাড়ার রকগুলি। আগে প্রবীণদের আড্ডা বসত হিদারাম ব্যানার্জি লেনের একটি চায়ের দোকানে। সেই দোকানটা আর নেই। ক্ষণিকের আড্ডা
বসে কখনও কোনও বাড়ির সামনে, কখনও বা পাড়ার মোড়ে চেয়ার পেতে।
এ পাড়ায় কোনও বারোয়ারি দুর্গাপুজো হয় না। ফলে বাড়ির পুজোর আকর্ষণ আজও অটুট। প্রায় দুশো বছরেরও বেশি পুরনো আমাদের দুর্গোৎসব। এ ছাড়াও দত্তবাড়ি, নীলমণি দে ঠাকুরবাড়িতেও পুজো হয়। এ ছাড়াও কালী, জগদ্ধাত্রীর পুজোর পাশাপাশি এ পাড়ার রথযাত্রাও আকর্ষণীয়। আগে কালীপুজোর পরে পাড়ায় জলসা হতো। আসতেন বহু শিল্পী।
অন্য পাড়ার মতো এখানেও উন্নত নাগরিক পরিষেবা মিলছে। স্থানীয় কাউন্সিলর এলাকার উন্নয়নে আগ্রহী। পাড়াটা এখন বেশি পরিচ্ছন্ন। ব্লিচিং ও মশার তেল ছড়ানো হয় এলাকায়। তবু কিছু অসচেতন বাসিন্দা মাঝে মাঝেই রাস্তায় ছুড়ে ফেলেন আবর্জনার প্যাকেট।
এ দিকে, শিয়ালদহের কোলে মার্কেট কাছেই হওয়ায় ভোর থেকেই হিদারাম ব্যানার্জি লেন দিয়ে শুরু হয় পণ্যবাহী ভ্যান রিকশার যাতায়াত। সঙ্গে বেড়েছে তীব্র গতিতে বাইকের যাতায়াত। ফলে যে কোনও সময়ে
ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। তবে এ পাড়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভাল। এক দিকে শিয়ালদহ স্টেশন, অন্য দিকে মেট্রো।
কাছেই লেবুতলা পার্কের সংস্কার ও সৌন্দর্যায়ন হয়েছে। সকাল-সন্ধ্যায় এলাকার মানুষ সেখানে বেড়াতে যান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য খেলাধুলোর অভ্যাস কমায় স্কুল থেকে ফিরে মাঠে যাওয়ার বদলে ছোটদের কোচিংয়ে যেতে দেখা যায়। কাছেই বিশ্বনাথ মতিলাল লেনে আজ ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়।
এ পাড়ায় বহুদিন যাবৎ বেশ কিছু ওড়িশাবাসী মানুষের বাস থাকায় তাঁদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। এ পাড়ায় থাকতে থাকতে তাঁরাও বাঙালি হয়ে গিয়েছেন। রয়েছেন সুবর্ণ বণিক সম্প্রদায়ের মানুষও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ পাড়ায় বেশ কিছু বাড়ির নীচে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন দোকান। রয়েছে সোনার দোকানও। অনেক রাতেও কাজ চলে।
অতীতের পাড়াটকে আজ মনে হয় এক ভিন্ন স্বপ্নরাজ্য। পাড়াতেই ছিল সুর ও বাণী সঙ্গীত শিক্ষায়তন। সেখানে মাঝে মাঝে আসতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্রের মতো শিল্পীরা।
এ পাড়াটা দোলের সময়ে যেমন রঙিন হয়ে উঠত, সে ছবি কিন্তু আজও বদলায়নি। তবে বিশ্বকর্মা পুজোয় গোটা আকাশ যেমন ঘুড়িতে ছেয়ে থাকত, এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। অতীতে এ পাড়ার বাবু কালচারের রেশ, বুলবুলির লড়াই, পায়রা ওড়ানো, বৈঠকী গানের আসর— সবই আজ ইতিহাস। কমে এসেছে দিনের নানা সময়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ফেরিওয়ালার ডাকও। এখন আসে পুরনো খবরের কাগজওয়ালা আর শীত কালের সেই ধুনুরি। একে একে হারিয়ে গেল বাসনওয়ালা, ঘটিগরম, গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সেই কুলফি-মালাইওয়ালা।
তবে কিছু হারানো আর কিছু প্রাপ্তির মাঝে আজও অটুট মানুষে মানুষে আত্মিক টান। ভালবাসা আর সম্পর্কের উষ্ণতা এ পাড়ায় ধরে রেখেছে আমাদের সকলকে।
লেখক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy