Advertisement
০১ মে ২০২৪
কসবা

কাঠগড়ায় রাজনীতি, রাগে ফুঁসছে এলাকা

‘ভাল মানুষ’ বলেই এলাকায় পরিচিতি ছিল তাঁর। শান্ত স্বভাব ও পরোপকারী মনোভাবের জন্য ওই যুবককে এক ডাকে চিনতেন সকলে। পাড়ার খুদেদের মধ্যেও ছিলেন জনপ্রিয়। কারণ প্রতিদিন সকাল কাজে বেরোনোর সময়ে এক মুঠো করে লজেন্স কিনে বিলি করতেন কচিকাঁচাদের।

পলাশ জানার স্ত্রী ও মেয়ে। বুধবার। — নিজস্ব চিত্র

পলাশ জানার স্ত্রী ও মেয়ে। বুধবার। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৫১
Share: Save:

‘ভাল মানুষ’ বলেই এলাকায় পরিচিতি ছিল তাঁর। শান্ত স্বভাব ও পরোপকারী মনোভাবের জন্য ওই যুবককে এক ডাকে চিনতেন সকলে। পাড়ার খুদেদের মধ্যেও ছিলেন জনপ্রিয়। কারণ প্রতিদিন সকাল কাজে বেরোনোর সময়ে এক মুঠো করে লজেন্স কিনে বিলি করতেন কচিকাঁচাদের। রোজের মতো মঙ্গলবারও কাজে বেরিয়ে পকেট ভরা লজেন্স কিনেছিলেন। কিন্তু তা বিলি করার আগেই ভোজালির এলোপাথাড়ি কোপে লুটিয়ে পড়লেন বছর সাঁইত্রিশের তরতাজা প্রাণ।

তিনি পলাশ জানা, কসবার তালবাগান তাণ্ডবে নিহত যুবক। যাঁর অপমৃত্যুতে এলাকা জুড়ে নেমে আসা শোকের ছায়া চাপা পড়ে গিয়েছে ক্ষোভের আগুনে। মঙ্গলবারের এই হত্যাকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত জয়দেব দাস-সহ এ পর্যন্ত পাঁচ জন গ্রেফতার হয়েছে। খুন, সংঘর্ষ ও অস্ত্র আইনে মামলা রুজু হয়েছে। কিন্তু এলাকাবাসীর দাবি, স্থানীয় ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিজনলাল মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর ‘ডান হাত’ বিশ্বজিৎ পোদ্দার ওরফে সোনা পাপ্পুকে গ্রেফতার করতে হবে।

এই দাবিতেই বুধবার সকাল থেকে কসবা থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখান পলাশ জানার পরিবার ও প্রতিবেশীরা। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ তালবাগান বস্তির প্রায় শ’দেড়েক মানুষ যান কসবা থানায়। অভিযোগ, কাউন্সিলরের প্রশ্রয়েই মঙ্গলবার সোনা পাপ্পু এলাকায় দুষ্কৃতী দল নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। প্রকাশ্যে ভোজালি দিয়ে কুপিয়েছে, বোমা ছুড়েছে। ঘটনায় কাউন্সিলর ও পাপ্পু জড়িত— এ কথা জানিয়ে এ দিন কসবা থানায় লিখিত অভিযোগও জমা দেন স্থানীয়েরা। পুলিশ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে। ময়না তদন্তের পরে এ দিন সন্ধ্যায় পলাশের দেহ এলাকায় নিয়ে এসে শোক-মিছিল হয় ও পরে তাঁর শেষকৃত্য হয়।

পলাশের ভগ্নিপতি বিমল হালদারের অভিযোগ, এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সিন্ডিকেটরাজ চালাচ্ছে পাপ্পু। মাঝে মধ্যেই এলাকাবাসীকে ‘চমকাতে’ আসে সে। ২০১৫ থেকে তার বিরুদ্ধে অন্তত ১৩টি অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রতি বারই কাউন্সিলর বিজনবাবুর প্রভাবে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছে সে। সম্প্রতি তার হাত ধরে ব্যবসা শুরু করে ঘটনার মূল অভিযুক্ত জয়দেব।

এ দিন ধৃতদের আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য থানা থেকে বার করার সময়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন এলাকাবাসী। মঙ্গলবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা এক বাক্যে জানান, ঘটনায় কোনও ভাবেই জড়িত ছিলেন না পলাশ। সোমবার গোলমালের সূত্রপাত হয় অভিযুক্ত জয়দেবের স্ত্রী মামণি দাস এবং তাঁর পড়শি বাবু হালদারের কিশোরী মেয়ে ববি হালদারের মধ্যে। তার জেরেই ওই রাতে বাবুর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন জয়দেব। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এর পরে মঙ্গলবার জয়দেব দলবল নিয়ে চড়াও হয় বাবুর উপরে। বন্ডেল গেটের কাছে তাঁকে মেরে, হাত-পা ভেঙে, রেললাইনের উপরে ফেলে দেয় তারা।

বাপি নাইয়া নামের এলাকার এক তৃণমূল কর্মী জানান, তাঁরা অনেকে মিলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাবুকে। তখন তাঁর কাছে কাউন্সিলর বিজনবাবুর ফোন আসে। বুধবার বাপি দাবি করেছেন, বিজনবাবু ফোনে তাঁকে বলেন, ‘‘তোরা ওদের কেন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিস। এ বার বাইরের ছেলে এলাকায় ঢুকে মারধর করলে সামলাতে পারবি তো?’’ বিজন-ঘনিষ্ঠ পাপ্পু ও জয়দেবদের হাতে মার খাওয়া বাবুর পাশে তাঁর এলাকারই তৃণমূল কর্মীরা কেন দাঁড়াবেন, সেই রাগ থেকেই কিছুক্ষণ পরে শ’দুয়েক সশস্ত্র গুণ্ডা এলাকায় পাঠানো হয় বলে দাবি বাপি-সহ এলাকার একাধিক তৃণমূলকর্মী অমরদীপ, মনোজ, বিমল প্রমুখের। কিছু পরেই সোনা পাপ্পু দলবল নিয়ে এলাকায় ঢুকে হামলা চালায়। যোগ দেয় জয়দেবও। তখনই তাদের সামনে পড়ে গিয়েছিলেন পলাশ। ভোজালি দিয়ে কোপানো হয় তাঁকে।

এ দিকে, পলাশের তেরো বছরের মেয়ে রিঙ্কির চোখেমুখে এখনও আতঙ্ক। ঘটনার দিন সকালে বাবার সঙ্গেই ছিল সে। খবর পেয়েছিল পড়শি বাবু হালদারের মার খাওয়ার। হঠাৎই রে রে করে এলাকায় ঢোকে শ’দুয়েক ছেলে। কয়েক জনকে চিনতেও পারে সে। বলে, ‘‘একটি বড় ভোজালি নিয়ে বাবার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল জয়দেব। রানা, কেষ্টও ছিল। ওরা পাড়ার ছেলে। হাতে বড় রড ছিল। বাবাকে বাঁচাতে গেলে ওরা রড নিয়ে তাড়া করে। মাসির বাড়ি গিয়ে লুকোই। তার পরেই বোমার শব্দ পাই।’’

রিঙ্কি জানায়, কিছু পরে গিয়ে সে দেখে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাবার দেহ। ততক্ষণে বোমার শব্দে সব দোকানপাট বন্ধ। কেউ নেই সাহায্য করার মতো। সে বলে, ‘‘অতক্ষণ ধরে পুলিশ দেখতে পেলাম না, একটা গাড়ি পেলাম না বাবাকে নিয়ে যেতে।’’ রিঙ্কির মা, ৩১ বছরের তরুণী শ্যামলী জানা ঘটনার পর থেকেই বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। বিছানা নিয়েছেন পলাশের মা দুর্গা জানা। এলাকার মহিলাদের অভিযোগ, মামণি প্রায়ই নানা রকম অশান্তি করতেন, ঝগড়ঝাঁটিতে জড়িয়ে পড়তেন। সোমবারও তা-ই হয়। বুধবার ববির মা সীমা হালদার বলেন, ‘‘এলাকায় পঞ্চাশটি পরিবার। মেয়েদের জন্য মাত্র দু’টি শৌচাগার। তা নিয়ে ঝামেলা প্রায়ই হয়, মিটেও যায়। সে দিনও মিটে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরেও মামণির স্বামী জয়দেব আমার স্বামী বাবু হালদারের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করে।’’ সীমার অভিযোগ, থানা থেকে ফিরে রীতিমতো শাসিয়ে যায় জয়দেব। বলে, ‘‘দেখিয়ে দেব আমি কী করতে পারি।’’

স্থানীয় তৃণমূলের যুব প্রেসিডেন্ট উমেশকুমার সিংহ এ দিন বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিনিধিত্ব করে কসবা থানার পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর অভিযোগ, বিজনলালের আশীর্বাদধন্য পাপ্পু গোটা ঘটনার নায়ক। বস্তুত পাপ্পুর অত্যাচারে এলাকায় কোনও নতুন বাড়ি বা জমি নিয়ে কাজ করাই দায় হয়ে গিয়েছিল। সূত্রের খবর, কোনও নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হলেই বর্গফুটপিছু ৫০ টাকা করে আদায় করত সে। সত্যেন বোস নগর কলোনির ডলি নস্করের অভিযোগ, গত বছর পুজোয় তাঁর বাড়ি তৈরি শুরু হয়। দেড় লক্ষ টাকা চায় পাপ্পু। তিনি বাড়ির কাজ শেষ করতে পারেননি। এ রকম অভিযোগ এলাকায় অনেক। অভিযোগ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আড়াল থেকে মদত দিয়েছেন কাউন্সিলর।

সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বিজনবাবু অবশ্য জানান, তিনি এলাকার অভিভাবকের মতো। সকলকেই চেনেন। কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁদের ক্ষতি হল, তাঁদের অসহায়তার সুযোগে কিছু লোক রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, কোনও পক্ষপাত নয়, দোষীরা যেন চরম শাস্তি পায়।’’ সোনা পাপ্পুর বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর অভিযোগ এবং তার সঙ্গে কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত হোক না, তাতেই সব পরিষ্কার হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Political conflict TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE