রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেই কি তাঁর নামে প্রেসক্রিপশন হতে পারে?
রোগী মারা যাওয়ার পরেও তাঁর জন্য প্রেসক্রিপশন করা যায়?
আপাতত এই তথ্য জেনে বাকরুদ্ধ হালিশহরের সরকারপাড়ার বাসিন্দা বীরভদ্র হালদার। তবে তিনি হাল ছাড়তে চাননি। এর একটা হেস্তনেস্ত করতে যাবতীয় কাগজপত্র রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে জমা দিয়ে বিচার চেয়েছেন। অভিযোগ করেছেন, ‘‘এত দিন গল্প শুনতাম, রোগী মারা যাওয়ার পরেও নাকি তাঁকে ভেন্টিলেটরে ঢুকিয়ে বাড়ির লোককে বোকা বানিয়ে অনেক হাসপাতাল মোটা টাকার বিল বানায়। এ বার তো নিজেই এ রকম একটা পরিস্থিতিতে পড়লাম। এর কি কোনও সুরাহা নেই? এ ভাবে প্রতারিত হওয়াটাই কি আমাদের ভবিতব্য?’’
হাসপাতালেরই নথি অনুযায়ী, বীরভদ্রবাবুর ৮৪ বছরের মা সুশীলা হালদার হাসপাতালে ভর্তি হন চলতি বছরের ২০ এপ্রিল রাত ৮টা বেজে ২৭ মিনিটে। অথচ হাসপাতালই সেই রোগীর ছ’-সাত রকম ওষুধ এবং ইঞ্জেকশনের প্রেসক্রিপশন লিখেছে ওই দিনই সকাল ১০টায়! পাশে আবার গোটা গোটা করে লেখা—‘আর্জেন্ট!’
কিন্তু যে সময়ে রোগী ভর্তিই হননি, সেই সময়ে তাঁর জন্য ওষুধ লেখার মতো অসম্ভব কাণ্ড ঘটল কী করে? কোন যাদুমন্ত্রে কলকাতার ওই নামী বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জেনে গেলেন যে, তখনও পর্যন্ত তাঁদের ‘অদেখা’ ওই রোগীর ‘আর্জেন্ট’ বা জরুরি ভিত্তিতে ওই ওষুধ ও ইঞ্জেকশন প্রয়োজন?
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সবিনয় নিবেদন, ‘‘লিখতে গিয়ে সময়টা একটু ভুল হয়ে গিয়েছে। ওই টাকাটা রিফান্ড হয়ে যাবে। মানে, রোগীর বাড়ির লোক ওই ওষুধের টাকা ফেরত পাবেন।’’
তবে ‘ভুল’ এর এখানেই শেষ ভাবলে বড় ভুল হবে।
কারণ হাসপাতালের নথিই বলছে, সুশীলাদেবীর মৃত্যু হয়েছিল ২৮ এপ্রিল সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে। আর ওই দিনই সকাল সাড়ে ১১টায় রোগীর নামে হাসপাতাল একটি প্রেসক্রিপশন তৈরি করেছে। তাতেও বেশ কিছু ওষুধ ও ইঞ্জেকশন লেখা। এবং সেখানেও বড় করে ‘আর্জেন্ট’ লেখা রয়েছে! অর্থাৎ যে রোগিণীর আগেই মৃত্যু হয়েছে, তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ দিতে নির্দেশ দেওয়া আছে প্রেসক্রিপশনে।
এখানেও থামেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর একটি প্রেসক্রিপশন তৈরি করা হয়েছে আরও ৪০ মিনিট বাদে, দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে! সেখানেও বেশ কিছু ওষুধ আর ইঞ্জেকশন লেখা।
মৃত রোগীর জন্য কখনও প্রেসক্রিপশন লেখা হয়? ওষুধে কি মৃত রোগী বেঁচে ওঠেন?
বাইপাসের ধারের ওই বেসরকারি হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার তাপস ঘোষ এবং মেডিক্যাল সুপার সৌমেন্দু সেন তাঁদের ব্যাখ্যায় জানিয়েছেন— রোগীর একেবারে শেষ অবস্থায় যখন যমে-মানুষে টানাটানি চলে, তখন বেশ কিছু ওষুধ ও ইঞ্জেকশন হাসপাতালের ওয়ার্ডের স্টক থেকে নিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময়ে ওগুলি লেখা হয় না। রোগী মারা যাওয়ার পরে প্রেসক্রিপশন হিসেবে সে সব লেখা হয়। এটাই নাকি তাঁদের হাসপাতালের রীতি।
আর ‘আর্জেন্ট’ লেখা সম্পর্কে তাঁরা জানিয়েছেন, মৃতদেহে পচন শুরু হওয়া আটকাতে দ্রুত সংরক্ষণ এবং বাড়ির লোকের হাতে দ্রুত তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ হিসেবে ‘আর্জেন্ট’ লেখা হয়েছিল।
কোনটা নিয়ম, কোনটা নিয়ম নয়, তা জানতে পূর্বাঞ্চলে বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হসপিটাল অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’-র প্রেসিডেন্ট রূপালি বসুকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘‘রোগীর একেবারে শেষ সময়ে যদি হাসপাতাল নিজেদের ভাঁড়ার থেকে কিছু ওষুধ দিয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে কোনও কোনও সময়ে মৃত্যুর কিছু পরে সেগুলি লেখা হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সে সব ‘প্রেসক্রিপশন’ হিসেবে না লিখে ‘ইনডেন্ট’ হিসেবে লেখা উচিত। তা হলে ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো যায়। ‘প্রেসক্রিপশন’ বললে একটু অন্য জিনিস বোঝায়।’’
বীরভদ্রবাবু নথিপত্রে আরও বেশ কিছু গোলমালের বিষয় তুলে ধরেছেন। যেমন, তাঁর মা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০ এপ্রিল রাত ৮টা ২৭ মিনিটে। আর হাসপাতালের নথিতে দেখা যাচ্ছে, তাঁর রক্ত নেওয়া হয়েছে ওই দিন রাত ৮টা বেজে ২২ মিনিটে!
কী করে তা হয়?
সৌমেন্দুবাবুর জবাব, ‘‘ইমার্জেন্সি কেসে অনেক সময়ে রোগীকে খাতায়-কলমে ভর্তি করার আগেই আমরা রক্ত নিয়ে নিই। সময় নষ্ট করি না।’’ যা শুনে বীরভদ্রবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘সম্পূর্ণ বাজে কথা। মা-কে অগ্রিম ৩০ হাজার টাকা দিয়ে, সব ফর্ম পূরণ করিয়ে তবে ওঁরা ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়েছেন। তার আগে কোনও ব্লাড টেস্ট হয়নি।’’ আবার ২৩ তারিখের একটি নথিতে দেখা যাচ্ছে, পরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়া হয়েছে রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে। অথচ সেই রক্ত জমা পড়ে গিয়েছে ওই দিন রাত ১০টা ৩০ মিনিটে! অর্থাৎ রক্ত নেওয়ার পাঁচ মিনিট আগেই! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য একেও বলেছেন, ‘লেখার ভুল।’
সুশীলা হালদারকে ২০ এপ্রিল ভর্তি করা হয়েছিল আইসিইউয়ের ৮০২১ নম্বর শয্যায়। অথচ হাসপাতালের ২৮ এপ্রিলের নথি অনুযায়ী, রাত সাড়ে ১২টায় তাঁর বিল হয়েছে ৮০২১ শয্যা থেকে, দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে বিল হয়েছে ৮০৩৭ শয্যা থেকে, তাঁর ডেথ সার্টিফিকেট হয়েছে ৮০২১ শয্যা থেকে এবং মৃত্যুর আধ ঘণ্টা পরে একটি প্রেসক্রিপশন হয়েছে ৮০৩৭ শয্যা থেকে! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘‘চিকিৎসকেরা তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী শয্যা বদল করতেই পারেন।’’ মোট বিল হয়েছিল প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার।
রোগীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের তরফে কুণাল সাহা সব শুনে বলেছেন, ‘‘এর থেকে আরও এক বার প্রমাণিত হল, নামী বেসরকারি হাসপাতালগুলি চিকিৎসার নামে কী ভাবে মানুষকে লুটে ব্যবসা চালাচ্ছে। অসহায় মানুষ শোকের মুহূর্তে বিল অত খুঁটিয়েও দেখে না, টাকা মেটাতে সর্বস্বান্ত হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy