বৃহস্পতিবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে তৃণমূল ছাত্রনেতা সৌরভ অধিকারী। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
পরনে সবুজ-কালো চেকশার্ট, ফেডেড জিন্স। পায়ে বাহারি চপ্পল। শার্টের খোলা বোতামের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে গেঞ্জি। তাঁকে ধরে বেঁধে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারের উপরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন দুই বন্ধু। তিনি উঠছেন না, হেসে গড়িয়ে পড়ছেন বন্ধুদের গায়ে।
তিনি সৌরভ অধিকারী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মুখ। বুধবার সেনেট হলে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় মূল অভিযুক্তও তিনি। এবং এত কিছুর পরেও তিনি অকুতোভয়। আর পাঁচটা দিনের মতোই স্বাভাবিক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাদের একাংশই বলছেন, সৌরভ বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেওয়ার দিন থেকেই ‘অকুতোভয়’। কারণ সৌরভ জানেন, মাথায় ছাতা ধরে রয়েছেন দাদারা। হাজারো দোষেও আঁচ লাগবে না গায়ে। তাই বারবার বিভিন্ন ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েও তিনি বদলান না। টিএমসিপি-র একাংশ অবশ্য বলছেন, সৌরভ বদলাবেন কেন! বুধবার সন্ধ্যায় সংগঠনের বৈঠকে তাঁকে বাহবা দিয়েছেন দলের শীর্ষনেতারা। পরামর্শ হিসেবে শুধু বলেছেন, সংবাদমাধ্যমের হাত থেকে নিজেকে ‘বাঁচাতে’ জানতে হবে। বৃহস্পতিবার দিনভর অতএব সেই চেষ্টাই করে গিয়েছেন সৌরভ। যত বারই তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তত বারই বলেছেন, ‘‘নো কমেন্টস।’’
এ দিন সকাল থেকে কলেজ স্ট্রিট বা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ, কোথাওই সৌরভের পাত্তা মিলছিল না। অগত্যা সায়েন্স কলেজের গেটেই তাঁর অপেক্ষায় ছিল সংবাদমাধ্যম।
বেলা দেড়টা নাগাদ এসে থামল একটি দুধসাদা মারুতি ডিজায়ার। তার ভিতর থেকে নেমে কার্যত এক লাফে কলেজের ভিতরে ঢুকলেন সৌরভ। সোজা চলে গেলেন ইউনিয়ন রুমে। পিঠের ব্যাগটা রেখে ফিরে এলেন গেটের কাছে নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরের সামনে। সেখানে তখন পোস্টার লিখছেন তাঁর অনুগত কর্মীরা। কোমরে হাত দিয়ে নির্দেশ দিলেন তিনি। মেপে নিলেন চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কান পাতলেই শোনা যায়— দলের নেতারাই শুধু যে সৌরভে মুগ্ধ তা নয়, পুলিশও সৌরভকে বিশেষ ঘাঁটায় না। এ দিন সেই খবরের সত্যতাও মালুম হল। ভরদুপুরে মোটরবাইকে চেপে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে বেরোলেন সৌরভ। মাথায় হেলমেট নেই। গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে এক দল পুলিশ! কেউই সৌরভকে আটকাননি।
কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে পৌঁছেই সৌরভ ডেকে নিলেন তাঁর দলবলকে। সংগঠনের পতাকা হাতে মূল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে শুরু করে দিলেন বিক্ষোভ-স্লোগান। গলার শিরা ফুলিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, এমন সময়ই একটা ফোন এল মোবাইলে। ফোন কানে নিয়ে একটু দূরে সরে গেলেন সৌরভ। ফিরে এলেন একটু নরম মেজাজে। এ বার যেন দলবলকে সামলাচ্ছেন, এমন ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়তে লাগলেন।
ফোনের ও-পারে কে ছিলেন?
সৌরভ মুখ খোলেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ এক টিএমসিপি কর্মী জানান, ফোনটি এসেছিল সংগঠনের শীর্ষ স্তর থেকে। টিভিতে সৌরভের বিক্ষোভ-স্লোগান দেখেই ওই নেতা তাঁকে নির্দেশ দেন, ‘‘সংবাদমাধ্যম রয়েছে। এখন ‘বাড়াবাড়ি’ করা উচিত হবে না।’’
তবে একেবারে গুটিয়ে যাননি সৌরভ। কী ভাবে, কী করতে হবে— বারবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোণায় ডেকে নিয়ে গিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন অনুগামীদের।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, খাস সেনেট হলে শিক্ষক নিগ্রহের পরে এক ছাত্রনেতা এমন নির্বিকার থাকতে পারেন কী করে? কেনই বা সব কিছু দেখার পরেও তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সংগঠন কোনও ব্যবস্থা নিল না? সৌরভের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজনীতি করা ছাত্রদের অনেকেই বলছেন, এই ছাত্রনেতার মাথায় যেমন সংগঠনের শীর্ষনেতাদের হাত রয়েছে, তেমনই খাস দলের শীর্ষনেতাদের একাংশও সৌরভের ‘গুণপনার’ কদর করেন।
রাজাবাজার থেকে কলেজ স্ট্রিট, তাই ‘সৌরভ’ময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy