অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
অভিজ্ঞতা ১
রাত ৯ টা ৩৫। চাঁদনি চক: এসি রেকে উঠে মহিলাদের আসনেই বসেছিলাম। কামরায় লোক থাকলেও মহিলা যাত্রী হাতেগোনা। এসপ্ল্যানেড থেকে চার-পাঁচ জন মহিলা উঠলেন। বেশির ভাগই বসলেন আমার উল্টো দিকের আসনে। লাল টি-শার্ট পরা দুই যুবকও উঠে সটান এসে বসল আমার পাশে। এক জন বেশ মোটাসোটা, লম্বা। অন্য জন ছিপছিপে। এক যুবক আমার পায়ের উপরে পা রাখতে অস্বস্তিতে পড়লাম। ও পাশের মহিলা যাত্রীর আর সরার জায়গা নেই। যুবককে সরতে বললেও শুনতে পাচ্ছে না ভাব দেখিয়ে গল্প করছিল। কামরার কেউ প্রতিবাদ করেননি।
ময়দান থেকে আর এক তরুণী উঠে জায়গা না পেয়ে ওই দুই যুবকের সামনে দাঁড়ালেন। বাকি জায়গাটুকুতে বসা সম্ভব হচ্ছে না দেখে তিনি প্রতিবাদ করেন। লাভ হয়নি। জায়গাটা তখন নেশার গন্ধে ভরা। রবীন্দ্র সদনে এক মহিলা যাত্রী দুই যুবককে উঠতে বলেন। এতক্ষণে ছিপছিপে চেহারার যুবক উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎই খেয়াল করি, সে সোজা আমার দিকেই তাকিয়ে। চোখ সরিয়ে নিতে সে ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকে। খেয়াল করি, কিছু অঙ্গভঙ্গিও করছে। সহ্যের সীমা ছাড়ায়। কী দেখতে চাইছে? জানতে চাইতেই যুবকের সটান জবাব, ‘‘তুমকো দেখ রহা হুঁ। কিঁউ, দেখনা মানা হ্যায়? ’’ সরতে বললে জবাব, ‘‘তুমকো দেখুঙ্গা। কেয়া কর লো গে?’’
অনেক পরে এক জন এগিয়ে এসে দুই যুবককে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যান। তখনও হুমকি আসছে— ‘‘যো করনা হ্যায়, কর লো। পুলিশ বুলাওগে?’’ ট্রেন সুড়ঙ্গ থেকে বেরোতেই ফোন করলাম মেট্রোর জন্য নিযুক্ত কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিককে।
রাত ৯টা ৫২। মহানায়ক উত্তমকুমার: নেমেই আরপিএফকে খুঁজে সাহায্য চাই। ট্রেন বেরিয়ে গিয়েছে। মোবাইলে তোলা ওই দুই যুবকের ছবি দেখিয়েও লাভ হয়নি। ধরাও পড়েনি ওরা।
অভিজ্ঞতা ২
রাত ১০টা। চাঁদনি চক: শেষ মেট্রোর মিনিট দশেক দেরি। নীচে প্ল্যাটফর্মে বড্ড গরম। তবু বাইরের খোলা হাওয়ায় দাঁড়ানোর উপায় নেই। কারণ, সুনসান অফিসপাড়ায় স্টেশনে ঢোকার সিঁড়ি জুড়ে বসে একদল যুবক, বেশির ভাগই মত্ত। একলা সেখানে দাঁড়ানোর বদলে প্ল্যাটফর্মের গরম সহ্য করাটা তুলনায় নিরাপদ। আরপিএফ থাকে বটে স্টেশনের মুখে, তবে রোজ নয়। সঙ্গে কেউ ছিল না। নীচে নেমেও আঁতিপাঁতি খুঁজে নিলাম চেনা মুখ। একসঙ্গে বাড়ি ফেরাই ভাল।
রাত ১০টা ৩৫। গীতাঞ্জলি। শেষ মেট্রো থেকে নেমে এসক্যালেটরে প্রায় গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল লাল-সাদা স্ট্রাইপ শার্টের যুবক। নেশার গন্ধ-সহ। পরের সিঁড়িতে নেমে দাঁড়ালাম। ফের পাঞ্চগেটের সামনে পিঠে হাত। ঘুরে দাঁড়াতেই এ বার স্রেফ ‘সরি’। গুটিকয়েক সহযাত্রী ও মেট্রোকর্মী ছাড়া প্ল্যাটফর্ম, স্টেশন চত্বর সবটাই প্রায় ফাঁকা। দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে নিশ্চিন্ত। এ বার নিজের পাড়ায়।
স্টেশনের প্রবেশপথ, প্ল্যাটফর্ম বা মেট্রোর কামরা, রাতে কোথাওই স্বস্তি নেই। কারণ একই। মত্তদের উপস্থিতি— গান গেয়ে, তাকিয়ে, কখনও বা গায়ে ঘেঁষে দাঁড়ানো। চলন্ত ট্রেনে তো আর আরপিএফ থাকে না।
রাতের মেট্রোয় একলা মেয়ের যাতায়াতে পরিচিত পুরুষ সঙ্গে থাকা কি বাধ্যতামূলক?
অভিজ্ঞতা ৩
রাত ১০টা ১৫। পার্ক স্ট্রিট: জাদুঘরের দিক থেকে স্টেশনে ঢোকার মুখটা সুনসান, অন্ধকার। সামনের ফুটপাথে হকারেরা ব্যবসা গুটিয়েছে। স্টেশনের গেটের মুখে একটা জটলা। কয়েক জন মহিলা-পুরুষের কিছু বোঝাপড়া চলছে। পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লাম। পিছন পিছন আরও এক জন। পুরুষ। গেটে রক্ষী নেই। টিকিট কাউন্টারে পৌঁছতেও সুনসান সুড়ঙ্গ ধরে অন্তত মিনিট তিনেক হাঁটা। সরু পথে আরপিএফের বসার জায়গাই নেই। আঁকাবাঁকা পথে আলো আছে বটে, তবু সমস্যায় পড়লে কারও কাছে আওয়াজটুকুও পৌঁছবে না। মোবাইল জানান দিল, টাওয়ার নেই। অর্থাৎ, নিরাপত্তা খোঁজাটাই ভুল। ভয়-চিন্তা মাথায় নিয়েই প্ল্যাটফর্মে। শেষ মেট্রোর অপেক্ষায় তখন খুব কম যাত্রী।
রাত ১০.৩২। বেলগাছিয়া: শেষ মেট্রো যাওয়ার অপেক্ষায় স্টেশনের আলোগুলো। ‘অপ্রয়োজনীয়’ কিছু আলো নিভেও গিয়েছে। সুনসান আরপিএফ-হীন প্ল্যাটফর্মে নেমে ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করেই উঠে পড়তে হবে উপরে। স্মার্ট গেটের সামনে রেলরক্ষীদের চেয়ারও ফাঁকা। বন্ধ টিকিট কাউন্টারও। সকলেই দৌড়োচ্ছেন অটোর লাইনের দিকে। মহিলা সহযাত্রী এ সময়টায় কমই। রোজ যাতায়াতের সূত্রে মুখচেনা পুরুষদের সঙ্গেই পা মিলিয়ে ছুটতে হবে। তা না হলে গেটের সামনে নির্জন, অন্ধকার রাস্তায় একাই অটোর অপেক্ষা। প্রথম দু’একটা অটো বেরিয়ে গেলেই পাশে জুটবে মত্ত সহযাত্রী।
মেট্রো যা বলছে
মহিলাদের নিরাপত্তার দু’টি টোল-ফ্রি নম্বরে ফোন করলেই সাহায্য মিলবে, জানালেন মেট্রোর জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র। কিন্তু সুড়ঙ্গে ফোনের নেটওয়ার্ক থাকে না। আধিকারিকের বক্তব্য, পরের স্টেশনে নেমে আরপিএফকে জানালেও হবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার তো আরপিএফকে বোঝাতে বোঝাতেই ট্রেন বেরিয়ে গিয়েছে। কোন কামরা, দুই যুবকের ছবি দেখালেও ব্যবস্থা হয়নি। সব শুনে শুক্রবার ওই আধিকারিকের সাফাই, ‘‘আমায় ফোন করলেন না কেন? সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে পারতাম!’’ সাধারণ কোনও যাত্রী কী ভাবে জনসংযোগ আধিকারিকের নম্বর পাবেন? প্ল্যাটফর্মে আরপিএফ কর্মীরাই বা কীসের জন্য? সদুত্তর মেলেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy