Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দিকে দিকে শুধু নাই, টাকার জন্য হন্যে শহর

নাই নোট নাই! সোমবার সকাল সকাল পৌঁছে যাওয়া, নগদের খোঁজে লাইনে হাপিত্যেশ দাঁড়ানো মানুষকে কার্যত এমনই বার্তা দিল শহরের বেশির ভাগ ব্যাঙ্ক।

অর্থ-হীন। (বাঁ দিক থেকে) হাওড়া, এসপ্ল্যানেড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, লেকটাউন, তালতলা, রিজেন্ট পার্ক ও হরিশ মুখার্জি রোডে। সোমবার। — নিজস্ব চিত্র

অর্থ-হীন। (বাঁ দিক থেকে) হাওড়া, এসপ্ল্যানেড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, লেকটাউন, তালতলা, রিজেন্ট পার্ক ও হরিশ মুখার্জি রোডে। সোমবার। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৩
Share: Save:

নাই নোট নাই!

সোমবার সকাল সকাল পৌঁছে যাওয়া, নগদের খোঁজে লাইনে হাপিত্যেশ দাঁড়ানো মানুষকে কার্যত এমনই বার্তা দিল শহরের বেশির ভাগ ব্যাঙ্ক।

শনি-রবিবার ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। সোমবার সকাল হতেই অন্যান্য সব কাজ শিকেয় তুলে শহরবাসী ছুটেছিলেন ব্যাঙ্কে। অ্যাকাউন্টে টাকা আছে, অথচ হাতে নোট নেই— এই অবস্থা শুরু হয়েছে এ মাসের ৮ তারিখ রাতে। তার পর ২০ দিন সেই অবস্থা অব্যাহত। কিন্তু পরশু, বৃহস্পতিবার মাস পয়লা। সে দিন পরিচারিকা, বাড়ির গাড়িচালক, পুলকার, মুদির দোকানের খরচ নগদে মেটানো ছাড়া উপায় নেই। অথচ বহু জায়গাতেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠা লাইন হতাশ হল দুপুর না গড়াতেই। টাকা শেষ! এ দিনও বহু ব্যাঙ্কই গ্রাহকদের ফিরিয়েছে খালি হাতে। কিংবা চাহিদার তুলনায় অল্প টাকা দিয়ে। তার উপরে নতুন দু’হাজারি নোট হাতে পেয়েও অসহায় হয়ে থাকার অসন্তোষ তো আছেই।

একই অবস্থা এটিএমগুলিরও। মাসের চতুর্থ শনিবার ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকায় অধিকাংশ কিয়স্কেই টাকার গাড়ি ঢোকেনি। রবিবারও স্বভাবতই ছবিটা এক। আর পরিণতি? দু’-একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএমে টাকা মিললেও এ দিন সকাল থেকে সব এটিএমে শাটার অর্ধেক নামানো। নোটিস সাঁটা— ‘নো ক্যাশ’। কোথাও আবার টাকা থাকা সত্ত্বেও ফিরে যাচ্ছেন মানুষ। কারণ আছে শুধুই দু’হাজারি নোট। যা নিতে অধিকাংশ গ্রাহকই আগ্রহী নন।

টাকা তুলতে না-পেরে এ দিন সকালে দমদম ক্যান্টনমেন্টের নতুনবাজার তল্লাটের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে উত্তেজনা ছড়ায় এ দিন। অভিযোগ, ব্যাঙ্ক থেকে হাজার টাকার বেশি তুলতে দেওয়া হচ্ছিল না কাউকে। তাতে আবার সেই টাকা দেওয়া হচ্ছিল ১০ টাকার কয়েনে! এতেই বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন গ্রাহকেরা। ব্যাঙ্কের শাটার বাইরে থেকে নামিয়ে দিয়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয় দমদম থানার পুলিশ।

বাগবাজারে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় সকাল থেকেই দু’টি লাইন। দু’হাজারি নোট নিতে ইচ্ছুকদের লাইনে গোনাগুনতি কয়েক জন। অন্য লাইনটা ক্রমশ লম্বা হয়েছে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু তুমুল চেঁচামেচি, ভোগান্তির পরে ব্যাঙ্কে টাকার গাড়ি এল যখন, তখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল।

এ দিন অফিসপাড়ার বিভিন্ন ব্যাঙ্কে ঘুরে দেখা গিয়েছে— মাসের শেষেও প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা তুলতে না পারায় মাথায় হাত বহু গ্রাহকের। টাকা তোলার সর্বোচ্চ সীমা ২৪ হাজার হলেও বেশির ভাগ ব্যাঙ্কে দশ হাজারের বেশি মেলেনি। হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাঙ্কে যাঁরা ২৪ হাজার টাকা পাচ্ছেন, সেখানে আবার নতুন সমস্যা। অভিযোগ, ওই টাকার মধ্যে কিছু একশো টাকার নোট ছেঁড়া!

হাওড়ার বাসিন্দা, একটি বিমা সংস্থার কর্মী ডালিয়া ঘোষ টিকাদার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মিশন রো শাখায় ২৪ হাজার টাকা তুলতে এসে পেলেন দশ হাজার। চারটি দু’হাজার ও কুড়িটি একশো টাকার নোটে। একশো টাকার নোটের বেশির ভাগ জীর্ণ চেহারার। বদলে দিতে বললে ব্যাঙ্ক জানিয়ে দেয়, নতুন একশোর নোট নেই।

আর এন মুখার্জি রোডের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক ম্যানেজার বললেন, ‘‘একে টাকার জোগান চাহিদার তুলনায় খুবই কম। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরনো, ছেঁড়া একশো টাকার নোট।’’ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লালবাজার শাখার এক কর্মী বলেন, ‘‘দু’দিন ছুটির পর সোমবারের ভিড়ের কথা আন্দাজ করে শুক্রবার রাতেই কারেন্সি চেস্ট থেকে নগদ টাকা তুলতে গিয়েছিলাম। ৫০ লক্ষ চেয়ে পেয়েছি মাত্র ১২ লক্ষ। সোমবার দুপুর দেড়টায় সেই টাকা শেষ হয়ে গেল।’’

অফিসপাড়ার প্রায় কোনও এটিএমেই নতুন পাঁচশো টাকার নোট ছিল না এ দিন। অনেকের মতে, এই অবস্থার জন্য খুচরো পেতে উৎসুক গ্রাহকদের টাকা তোলার কৌশলও দায়ী। একটি এটিএমের নিরাপত্তারক্ষী শেখ তাজমুলের পর্যবেক্ষণ, ‘‘যখন টাকা থাকছে, অধিকাংশ গ্রাহকই পরপর দু’বার কার্ড ঢুকিয়ে প্রথম বার ১৬০০, দ্বিতীয় বার ৯০০ টাকা তুলছেন। ফলে, পাঁচশো, একশোর নোটই পাচ্ছেন তাঁরা। সেগুলি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। অন্যদের জন্য পড়ে থাকছে কেবল দু’হাজার টাকার নোট।

বাঘাযতীনের এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গত সপ্তাহ থেকে ২৪ হাজার টাকা তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন এক প্রবীণ নাগরিক। তাঁকে সোমবার আসতে বলা হয়েছিল। সেই মতো এ দিন সকাল থেকেই তিনি ব্যাঙ্কের লাইনে। ঘণ্টা দেড়েক পরে শোনেন, টাকা শেষ! ব্যাঙ্ককর্মীদের আশ্বাসে আরও ঘণ্টা খানেক অপেক্ষার পরে টাকার গাড়ি এল। তবে শেষমেশ তাঁর হাতে এল কেবল ১০ হাজার টাকা। তা-ও পাঁচটা দু’হাজারি নোটে! ব্যাঙ্ককর্মীকে অনুরোধ করে চারটে দু’হাজার টাকার এবং কুড়িটা একশো টাকার নোট নিয়ে ফেরার পথ ধরলেন বৃদ্ধ।

দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন ব্যাঙ্কেও ছবিটা একই রকম। দীর্ঘ লাইনগুলিতে দিনঘর শোনা গিয়েছে মাস পয়লার আশঙ্কার কথা। অনেকেই বলছেন, ‘‘এ মাস তো তা-ও কোনও রকমে চলে গেল। ১ তারিখ কী হবে? নতুন মাস, নতুন নোটে বেতন। সব তো ২০০০ নোট পাব। যা নিয়েও কাজের কাজ কিছুই হবে না।’’ এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘এত কাল তাকিয়ে থাকতাম, কবে মাইনে হবে! আর আজ মাইনের দিন যত এগিয়ে আসছে, তত ভয় হচ্ছে। কী ভাবেই বা প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে পারব, আর কী নোট পাব!’’ বেহালা চৌরাস্তায় ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়ানো তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী অনন্ত পাত্রের কথায়, ‘‘মাইনের নতুন দু’হাজারি বান্ডিল নিয়ে বাজারে বাজারে খুচরোর জন্য ঘোরার চেয়ে জমানো খুচরো দিয়ে টেনেটুনে কাটানোই ভাল।’’

দমদম এলাকার সমস্ত এটিএমেও টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল শুক্রবার রাতেই। শনিবার কোনও এটিএমে টাকা ঢোকেনি। রবিবার সন্ধেয় গোরাবাজারে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএমে টাকা এলেও, স্রেফ দু’হাজারি নোট। সোমবার দুপুর পর্যন্ত এলাকার অন্য এটিএমগুলিতে টাকা ছিল না। তাই ব্যাঙ্কেই লাইন দিয়েছেন মানুষ। এবং একই অভিযোগ। পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় প্রাপ্য টাকা মেলেনি। মিললেও দু’হাজারি নোটে।

শহর জুড়ে এই আতান্তরের মধ্যে অনেকেই অবশ্য বলছেন, এই আকালে দু’হাজারের নোটও নিয়ে নিতে হবে। তার পরে ভাঙানোর চেষ্টা করতে হবে। অনেকের বিশ্বাস, পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিলের পরে বাজারে ঢালাও একশো টাকার নোট ঢুকেছে। ফলে হাতে দুয়েকটা দু’হাজারি নোট থাকলেও একটু বেশি টাকার জিনিস কিনে তা ভাঙিয়ে ফেলা যাবে।

পল্লিশ্রী, বিজয়গড়, বাঘা যতীন, যাদবপুর, রানিকুঠির বিভিন্ন এটিএমে ঝুলেছে ‘নো ক্যাশ’ নোটিস। নিরাপত্তা কর্মীরা শুধু বলেছেন, শুক্রবার টাকা শেষ হওয়ার পরে সোমবার দুপুর পর্যন্ত টাকা আসেনি। বিকেলে টাকা আসার কথা থাকলেও কখন আসবে জানা নেই। একমাত্র ভরসা ছিল ম্যুর অ্যাভিনিউয়ের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএম।

ব্যবসার কাজের জন্য নিজের কারেন্ট অ্যাকউন্ট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলতে রানিকুঠির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন রায়পুরের পলাশ দাস। ব্যাঙ্ককর্মী জানিয়ে দেন, ‘‘পঞ্চাশ হাজার দূরের কথা, এখন একটা টাকাও নেই। এক কর্মী টাকা আনতে গিয়েছেন। তিনি ফিরলে দশ হাজারের বেশি দিতে পারব না।’’

এনএসসি বসু রোডের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সকাল থেকেই গ্রাহকদের শুধু দু’হাজার টাকার নোট দেওয়া হচ্ছিল। কয়েক জন গ্রাহক আপত্তি জানালে ব্যাঙ্ককর্মীরা জানিয়ে দেন, ‘‘আমাদের কাছে যা আছে, তাই দিচ্ছি। নিয়ে নিন। কাল হয়তো এটাও মিলবে না।’’

এ সবের মধ্যেই গড়িয়ার একটি ব্যাঙ্কে সটান ম্যানেজারের কাছে হাজির বৃদ্ধা। হাতে থলিভরা দশ টাকার কয়েন ঠক করে নামিয়ে দিলেন টেবিলে। বললেন, ‘‘আপনাদের কয়েন আপনারাই রাখুন বরং! কেউ নিচ্ছে না। করবটা কী!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ATM Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE